নিচের কাহিনীটি সবে শুরু করেছি। এর শেষ কোথায় সম্বন্ধে আমার এই মূহুর্তে পরিষ্কার ধারণা নেই, এর যে কোন সঠিক সমাধান আমি দিতে পারব তাও মনে হয় না। এই পর্যায়ে শুধু প্রথম অধ্যায়টি দেয়া হল।

অদৃশ্য সমচ্ছেদ, একটি বিজ্ঞান কল্পকাহিনী

২০৩০:
ঘটনাটা কোথায় শুরু হয়েছিল কেউ বলতে পারে না। একটা নির্দিষ্ট ঘটনা নিশ্চয়ই একটা জায়গা থেকেই শুরু হবার কথা। কিন্তু এতদিন পরে আমি সেই ব্যাপারে নিশ্চিত নই। এই ব্যাপারে আমি অনেক ভেবেছি, কিন্তু কোন কূলকিনারা করতে পারি নি। কেউই পারে নি। অথচ মানুষের অস্তিত্বের প্রশ্নে এর থেকে বড় হুমকি বোধহয় হতে পারে না।

প্রথম অধ্যায়

১৯৩০:
স্টেশনের শেষ প্রান্তের কুয়াশাটা যেন বরফ হয়ে গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে ভেঙ্গে পড়বে। প্রচণ্ড শীত পড়েছিল সেই বছর। ৫৮ ডাউন ট্রেনটির অনেক আগেই এসে পড়ার কথা। এই হাড়-কাঁপানো শীতে স্টেশন মাস্টার মনোহর বাবু একটা শাল গায়ে দিয়ে পায়চারি করছেন অধৈর্য হয়ে। কামারডাঙ্গা থেকে সেই কখন ট্রেনটা ছেড়েছে, খুব বেশী হলে বারো মিনিট লাগে এই স্টেশনে পৌঁছাতে। কুড়ি মিনিট কখন পার হয়ে গেছে।

স্টেশনে একটাই প্ল্যাটফর্ম, একটাই লাইন। প্ল্যাটফর্মটা লম্বা, সেটার শেষ অংশটা ঢালু হয়ে নিচে নামতে নামতে আগাছার মধ্যে হারিয়ে গেছে। তারপরে বিশাল মাঠ। মাঠের পরে একটি গ্রাম, গ্রামটি ঢেকে রেখেছে বন। আজ জ্যোৎস্না রাত, মৃদু আলোয় সেই বনের উঁচু-নিচু গাছগুলি দিগন্তে জেগে আছে। রেলের পথ একটাই, কিন্তু এই সময় কোন আপ ট্রেন আসার কথা নেই, তাই সম্মুখ সংঘর্ষের ব্যাপারে মনোহর বাবু চিন্তিত নন। নিঝুম রাত, ট্রেনের শব্দ এতক্ষণে শোনা যাবার কথা। রামু যে এর মধ্যে কতবার মনোহরবাবুকে উত্যক্ত করেছে, “কাকাবাবু ট্রেন কখন আসবে? ট্রেন কি লেট হচ্ছে নাকি কাকাবাবু?” ট্রেন ঠিক কখন আসে সেটা জানা রামুর খুব দরকার, নইলে তার চা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। ট্রেন আসার ঠিক দশ মিনিট আগে রামু তার কেরোসিনের স্টোভ জ্বালায়।

রামুকে খুব স্নেহ করেন মনোহরবাবু। পনেরো-ষোল বছরের রামপ্রসাদ স্টেশনে চা আর বিস্কুট বিক্রী করে। তার মা ও বাবা দুজনেই অসুস্থ। আজ এক বছর হল সেই সংসার টানতে রামপ্রসাদ স্টেশনের চা-ওয়ালা। প্রথম থেকেই মনোহরবাবুর এই কিশোরের প্রতি মায়া জন্মে গেছে। স্টেশনের পুরোনো চা-ওয়ালাদের রোষানল থেকে রামপ্রসাদকে বাঁচিয়েছেন মনোহরবাবু। রামপ্রসাদকে সবাই রামু বলে ডাকে।

অবশেষে ট্রেনের আওয়াজ অন্যদিকের দিগন্ত থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে আসে। আসছে তাহলে, হাঁপ ছাড়েন মনোহর বাবু। এরকম রাত্তিরে কাঁহাতক হৃদযন্ত্রের ওপর ভার নেয়া যায়। দূরের গ্রামের বনটা ছাড়ালে বাঁকের মুখে এসে ট্রেনটা বাঁশি দেয়, তার জোরালো আলো আঁধার চিরে সূর্যের মত চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। প্রায় আধ-মাইল জায়গা জুড়ে একটা বিরাট অর্ধবৃত্তকে অনুসরণ করে ট্রেনটা। দিনের বেলা স্টেশনের দক্ষিণ দিকে সবুজ ধানের পাশে সুন্দর দেখা যায় ট্রেনটাকে, আর উত্তর দিকে গেলে বনের মধ্যে দিয়ে সেই ট্রেন দূরে মিশে যায় ধীরে।

ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে রাতের ট্রেন। তার ঝিক ঝিক শব্দ মনোহর বাবুর মনকে চঞ্চল করে দেয়। লৌহ শকটের কয়লার ঘন ধূমায়িত কুণ্ডলী শীতের আকাশের শীতলতায় থমকে যায়, নিচু হয়ে ছড়িয়ে পড়ে পাশের ধানের ক্ষেতের ওপর, জ্যোৎস্নার আলো তার কালো রঙ্গকে উজ্জ্বল করতে পারে না। প্ল্যাটফর্মে বিশাল ধাতব বাষ্পযন্ত্র হাঁসফাঁস করতে করতে ঢোকে। তার গরম ভাপে মূহুর্তে যেন শীতের আবেশ চলে যায়। ট্রেন থামলে মনোহরবাবু গার্ডের জন্য অপেক্ষা না করে দ্রুত ইঞ্জিনের দিকে যান। ইঞ্জিন ড্রাইভার কিশোরীলাল বিহারের লোক, সে হিন্দী বাংলা মিশিয়ে যা বলল তার মর্মার্থ হল কামারডাঙ্গা ট্রেন ঠিক সময়েই ছেড়ে ছিল। কিন্তু স্টেশনের পরই একটা ছোট বন, সেখানেই এমন ঘন কুয়াশা নেমে আসে যে এক ফুট দুরত্ত্বেও কিছু দেখা সম্ভব হচ্ছিল না। বাধ্য হয়ে ট্রেন খুব আস্তে চালাতে হয়, প্রায় হাঁটার গতিতে। এরকম প্রায় পনেরো মিনিট চলে তারপর কুয়াশা হালকা হয়ে যায়। এই হল মোটামুটি কাহিনী। কিশোরীলাল বলল, এরপর সে দ্রুত টেনে চালাবে, ভোর ছটায় শিয়ালদহ স্টেশনে ঠিক পৌঁছে যাবে।

এই সময়ে রামু দৌড়ে আসে। “কাকাবাবু, কাকাবাবু, আসুন আসুন, শীগগির আসুন,” রামু মনোহরবাবুকে উত্তর দেবার অবকাশ দেয় না, হাত ধরে টানে। “আঃ হাতটা ছাড় না আগে,” মনোহর বাবু বিরক্ত হলেও রামুকে কিছু বলতে পারেন না, রামুর নানা আব্দারে তিনি প্রশ্রয় দেন। রামু তাকে প্রায় ছেঁচড়ে প্রথম যাত্রী বগিটায় নিয়ে আসে। মনোহরবাবু বলেন, “হাতটা ছাড়রে রামু, আমার বুড়ো হাতটা ভেঙ্গে ফেলবি রে। কি হয়েছে বলবি তো আগে।”

রামুর কথা যেন আটকে গেছে। প্রথম বগিটার জানলাগুলোর দিকে তাকান মনোহর দাস। স্টেশনের টিমটিমে বিদ্যুতের আলোয় ঘসা কাঁচের পেছনে কিছু দেখা যায় না। রামু তাকে টেনে নিয়ে যায় বগিটার কাছে। “উঠুন, কাকাবাবু, উঠুন।” দুপাশের হাতলে ভর করে বগির পাদানিতে ভর করে মনোহর দাস ওপরে ওঠেন। অন্ধকারে কামরাটা ঠিক মত দেখা যায় না, ওপরে একটা বাতি থাকার কথা, সেটা কাজ করছে না। “দেখুন কাকাবাবু, দেখুন।” অফিস থেকে লন্ঠনটা নিয়ে আসা উচিত ছিল, ভাবেন মনোহর। কিন্তু কামরাটার মধ্যে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল। এমন নিস্তব্ধতা সেটা মনোহর বাবুর মনে খটকা জাগায়, শিরশির করে ওঠে তাঁর গা। সবাই ঘুমিয়ে আছে, ভাবেন তিনি। কিন্তু নিঃশ্বাসের কোন শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। “কাকাবাবু, এখানে কেউ নেই,” চিৎকার করে ওঠে রামু। “কি বলছিস, কেউ নেই,” ঠাণ্ডায় যেন মুখ জমে যায় মনোহরের, কথাগুলো বিকৃত হয়ে যায়। “কেউ নেই, কাকাবাবু, সবাই নেমে গেছে।” এক সময় কিশোরীলাল একটা লন্ঠন নিয়ে কামরায় ঢোকে। সেই হলুদ আলোয় মনোহর বাবু দেখেন সারা কামরা ফাঁকা। এদিক ওদিক বাক্স, স্যুটকেশ, হোল্ড-অল, চাদর ছড়ানো, কিন্তু কোন মানুষ নেই। কিশোরীলাল সাহসী লোক, সে লন্ঠন হাতে কামরার শেষ পর্যন্ত হেঁটে যায়। একটি মানুষও নেই, কিন্তু তাদের ব্যবহৃত সব জিনিস পড়ে আছে। বিহ্বলতার প্রথম ধাক্কা কাটিয়ে “পরের বগিটিতে চল,” বলেন মনোহর বাবু।

পরের কামরা থেকে একটি লোক নামছিল, মুখে সিগারেট। সে বলল, “ট্রেন এখানে কতক্ষণ থামবে, মশাই?” কিশোরীলাল আর মনোহরবাবু একে অপরের দিকে চাইলেন, তাঁরা উত্তর দিলেন না। এই ফাঁকে রামু ভেতরে ঢুকে আবার দরজায় এসে বলল, “এই কামরা ভর্তি, কাকাবাবু।” “ভর্তি?” বিস্ময়ের বাঁধ মানে না মনোহর দাসের। তিনি ও কিশোরীলাল ভেতরে ঢোকেন, মৃদু লন্ঠনের আলোয় দেখেন কামরার সব বেঞ্চই ভর্তি, তার মধ্যে বেশীরভাগ লোকই বসে ঢুলছে, কেউ একটু বেশী জায়গা করে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। নাক ডাকার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। জানলার পাশে বসা দু-একটি লোক জাগা, তারা যেন ঘুম থেকে সবে উঠেছে। সিগারেট-টানা লোকটি কৌতূহলী হয়ে তাদের পেছন পেছন ঢোকে।

এই কয়জনের আগমনে অনেকেরই ঘুম ভেঙ্গে যায়। মনোহর বাবু কি করবেন ভেবে পান না। এই কামরার সবাই তো ঠিকই আছে মনে হয়। কিশোরীলাল সাহায্য করে, “পরের কামরায় চলুন, বাবু।” নিচে নেমে তৃতীয় কামরায় ওঠেন তাঁরা, পেছনে থাকে সেই সিগারেট পান করা লোকটি। মনোহর বাবুই প্রথমে ওঠেন, আবার এক ধরণের নিস্তব্ধতা। গায়ে কাঁটা দেয় মনোহরের। আধো অন্ধকার চোখ সয়ে আসলে কামরায় কোন মানুষ দেখেন না। প্রথম কামরার মত এখানেও কোন লোক নেই, তাদের টিনের ট্রাঙ্ক, হোল্ড-অল, টিফিন ক্যারিয়ার আর চটি ছড়ানো মেঝেতে, বেঞ্চে, ওপরের বাঙ্কে। শীত যেন আরো চেপে বসে, কাঁপতে থাকেন মনোহর বাবু। সিগারেট-পানরত লোকটি কিশোরীলালকে পাশে সরিয়ে দিয়ে কামরার মধ্যে মুখ বাড়িয়ে দেয়। “একি এরা গেল কোথায়?” চিৎকার করে ওঠে সিগারেট সেবক। “চুপ, একদম চুপ,” মনোহর ধমকে ওঠেন। মাঝের করিডরটা দিয়ে সবাই ঢোকে। এর মধ্যেই কিশোরীলালের সহকারী তার দেশী লোক বনবিহারী একটা টর্চ নিয়ে আসে। মনোহর বাবু টর্চের আলোতে দেখেন অনেক বেঞ্চের ওপর চাদর বিছানো, দু-একটা বালিশ, তার মাঝে মাথার ছাপ এখনো স্পষ্ট। “চুপ, একদম চুপ,” এবার ফিসফিস করে বলেন মনোহর, যেন সব যাত্রীরা তাদের জন্য কোন অশুভ উদ্দেশ্যে বেঞ্চের নিচে তাদের জন্য লুকিয়ে আছে।

মনোহর বাবু অপেক্ষা করেন। তাঁর মনে হয় যে যাত্রীরা লুকিয়ে আছে, শুধুমাত্র কোন একটা নিস্তব্ধতার নিশ্চয়তা পেলেই যেন তারা সব বেরিয়ে আসবে। শীতটা যেন আরো চেপে বসে। “রামু, কিশোরীলাল, বনবিহারী,” কোন রকমে কথাগুলো উচ্চারণ করেন মনোহর, “অন্য বগিগুলো দেখে এস।” ওরা নেমে যায়। মনোহর অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকেন, শীতটা যেন আরো চেপে বসে। কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ পেছনে একটা শব্দ শুনে চমকে ওঠেন। ঘুরে দেখেন সেই সিগারেট-ফোঁকা লোকটি কাঁপছে। “কাঁপছেন কেন?” জিজ্ঞেস করে মনোহর। “শী..তে,” উত্তর দেয় সেই লোক। তার ভয়ার্ত মুখ মনোহরের অলক্ষ্যিত থাকে না। মনোহরের মনে হয় সব যাত্রী বেঞ্চগুলোর নিচে লুকিয়ে আছে, অথবা তারা সবাই মরে কোন অশরীরী আকার নিয়েছে যারা কিনা এখনই বেরিয়ে আসবে।

রামু আর বিহারীলাল ফিরে আসে। অন্য বগিগুলো সব ভর্তি। রামু কাঁপা স্বরে বলে, “কাকাবাবু, খামারতলার শ্মশানের পাশ দিয়ে ট্রেন এসেছে। আজ অমাবস্যা। বেতাল বার হয় নি তো কাকাবাবু?” “চুপ, একদম চুপ,” এসব কথাকে প্রশ্রয় দেন না মনোহর।

বগি থেকে নেমে অফিসের দিকে হাঁটতে থাকেন মনোহর। তিনি জানেন এই ঘটনার শেষ এত তাড়াতাড়ি হবে না।

খামারতলা স্টেশনের এই কাহিনীকে অনেকে গণ-অপহরণ বলে বর্ণনা করেছে। কিন্তু পঞ্চাশ জনের ওপর লোক উধাও হয়ে গেল, অপহৃত হলে তাদের মুক্তিপণ কেউ দাবি করত, আর তাদের মৃত্যু হলে গত একশো বছরে নিশ্চয় তাদের কোন দেহাবশেষ কোথাও পাওয়া যেত।

চলবে…

২য় পর্ব