বিসিএস-এর শেষ অধ্যায়

 

প্রদীপ দেব

 

বাংলাদেশে ভালো কোন সিস্টেম তৈরি হতে দীর্ঘ সময় লাগলেও ভালো সিস্টেম ধ্বংস করে দিতে খুব বেশি সময় লাগে না। বিসিএস পরীক্ষার কথা বলছি। ভালো সিস্টেম বলতে যা বোঝায় – বিসিএস পরীক্ষা ঠিক সেরকম ভালো না হলেও একটা পর্যায় পর্যন্ত তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল। কিন্তু সম্প্রতি ২৭তম বিসিএস পরীক্ষা নিয়ে যা ঘটলো এবং এখনো ঘটে চলেছে তাতে বিসিএস পরীক্ষার প্রতি আর আস্থা রাখা সম্ভব নয়। ভালো পরীক্ষা দিয়ে সম্পূর্ণ মেধার জোরে বিসিএস পাস করতে পারার নিশ্চয়তা এখন আর কেউ দিতে পারছে না। পরীক্ষা পদ্ধতির পুরোটাই এখন হয়ে পড়েছে অস্বচ্ছ গোলমেলে। অবশ্য এটাও ঠিক যে বাংলাদেশের সব সরকারী ব্যাপারের মত বিসিএস পরীক্ষা পদ্ধতিও কখনোই তেমন স্বচ্ছ ছিল না।

 

২৭তম বিসিএস পরীক্ষা চলাকালীন সময়েই লিখিত পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যাবার ব্যাপারটা জানাজানি হয়। মৌখিক পরীক্ষায় ব্যাপক দুর্নীতির কথা জেনে যায় সবাই। সবকিছুর পরেও রেজাল্ট প্রকাশিত হয়। কিন্তু দুর্নীতির মাত্রা এতটাই বেশি ছিল এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির মোড় হঠা এতটাই ঘুরে গেলো যে ২৭তম বিসিএস এর রেজাল্ট হজম করা সম্ভব হলো না। কিন্তু তাতে কী? আমাদের সিস্টেমের ফাঁকগুলো তাঁরা ভালো করেই জানেন – যারা ওগুলো তৈরি করেছেন। তাই যেখানে লিখিত পরীক্ষার খাতা পরিবর্তন করার প্রমাণ পাওয়া গেছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে – সেখানে পুরো পরীক্ষাটা বাতিল না করে শুধু মৌখিক পরীক্ষাটা বাতিল করা হলো।  আবার মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হলো। এবং তার পরের ইতিহাস সবাই জানেন।

 

এখন সারাদেশে ২৭তম বিসিএস সংশ্লিষ্টরা দুভাগে বিভক্ত। যারা শেষের বার পাশ করেছেন – তারা ৩০ নভেম্বরের মধ্যে চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন। আর যারা প্রথম বার পাশ করেছিলেন – কিন্ত দ্বিতীয়বার পাশ করতে পারেন নি তাঁরা দিশেহারা হয়ে কী করবেন বুঝতে পারছেন না। বস্তুবাদীরাও ভাগ্যকে মেনে নেয়ার কথা ভাবছেন। তাঁরা তাঁদের নিয়োগের দাবী আদায়ের জন্য আত্মঘাতী পর্যন্ত হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের বিভিন্ন রকম আশ্বাস দিয়ে শান্ত করা হয়। কিন্তু এখন পিএসসির চেয়ারম্যান সাফ জানিয়ে দিলেন যে তাঁদের ব্যাপারে পিএসসির করার কিছুই নেই। এর আগে উপদেষ্টা পরিষদে আলোচিত হয়েছে যে দ্বিতীয়বার মৌখিক পরীক্ষা নেয়াটাই ভুল হয়েছিল। কিন্তু সে ভুল করার অনুমোদন এই উপদেষ্টা পরিষদই দিয়েছিল। এটা যেন চিরকালীন সত্য যে ক্ষমতাবানরা ভুল করবেন আর নির্দোষ ক্ষমতাহীন তার মাশুল গুণবেন।

 

এপর্যন্ত পড়ার পর মনে হতে পারে যে ২৭তম বিসিএস পরীক্ষায় যারা প্রথমবার পাশ করেছিলেন, কিন্তু দ্বিতীয়বার পাশ করতে পারেননি তাদের প্রতি আমার নীতিগত সমর্থন আছে। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে আমাদের সমর্থন বা বিরোধীতা অনেকটাই ব্যক্তিগত ব্যাপার হয়ে গেছে। প্রথম আলো ২৭তম বিসিএস বিষয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন ছাপানো শুরু করলে – নিয়োগ প্রাপ্তদের মধ্যে এ বিশ্বাস প্রবল হয় যে প্রথম আলোর কোন উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তার আপনজন এবার পাস করতে পারেন নি। তথ্যের সত্য-মিথ্যা যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেয়ার সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে এখনো নেই। তাই অনেকের মনে হতে পারে যে আমার কোন আপনজন এবার পাস করতে পারেনি বলেই আমার এ লেখা। আসলে তা নয়। ২৭তম বিসিএস পরীক্ষার সাথে আমার ব্যক্তিগত কোন সম্পর্ক নেই। আমার সমর্থন বা বিরোধিতা ব্যক্তিগত কারণে নয়, নীতিগত কারণে।

 

আমি যারা দ্বিতীয়বার পাশ করতে না পেরে আন্দোলন করছেন তাদের সমর্থন করতে পারছি না কোন ভাবেই। কারণ দ্বিতীয়বার মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার সময়েই তাদের বোঝা উচিত ছিল যে তাঁরা হয় পাশ করবেন – নয় ফেল করবেন। রেজাল্ট যাই হোক মেনে নিতে হবে। এটাই নিয়ম। এবার যদি তারা পাশ করতেন – তাহলে তারা আন্দোলন করতেন না। এখানে নীতি কাজ করছে না – কাজ করছে নিজেদের ব্যক্তিগত পাশ বা ফেল। এখানে এখন যতই আদর্শের কথা বলা হোক না কেন – সেগুলো কাজ করেনি কখনো। এটা অবশ্যই স্বীকার করছি যে সরকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাদের করার কিছুই ছিল না কখনো। তারা সরকারী সিদ্ধান্তের পুতুল। এখনো তাই। একবার তাদের সামনে আশ্বাসের মুলো ঝুলানো হয় – আবার তা সরিয়ে নেয়া হয়। কাজে যুক্তি-নির্ভরতা কম বলেই আন্দোলন কারীরা একদিন আনুষ্ঠানিক ভাবে ধর্মীয় উপাসনালয়ে প্রার্থনার আয়োজনও করেছে। দুর্বল মানুষ অসহায় মুহূর্তে যুক্তি হারিয়ে ফেলে – এটাই স্বাভাবিক। তারা তাদের চেষ্টা চালিয়ে গেছেন যতটুকু পারা যায়। কিন্তু তাদের এ পরিস্থিতির মুখে যারা ঠেলে দিলেন – তাদের অবস্থান কোথায়? যারা দুর্নীতি করে এই সিস্টেমের বারোটা বাজিয়েছেন সেই পিএসসি মেম্বারদের কারো শাস্তি হয়েছে বলে তো শুনিনি।

 

বলা হলো বিসিএস মৌখিক পরীক্ষায় ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে – তাই আবার পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। যারা দুর্নীতি করেছেন – তারা তো কমিটি মেম্বার বা কোন না কোন ভাবে পরীক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট। তারা কি কোন শাস্তি পেয়েছেন? তাদের নাম কি জনগণ জানে? যে মৌখিক পরীক্ষায় প্রথমবার দুর্নীতি হয়েছিল – দ্বিতীয়বার যে হয়নি তার গ্যারান্টি কী? যারা প্রথমবার দুর্নীতি করে মনোনীত হয়েছিল বলে শুনেছি – তারা কি দ্বিতীয়বারও মনোনীত হন নি? আসলে আইনের মারপ্যাঁচ দেখিয়ে – কথার ফানুস উড়িয়ে পাবলিক সার্ভিস কমিশন যা খুশি তাই করেছেন ২৭তম বিসিএস পরীক্ষা নিয়ে।

 

২৮তম বিসিএস এর প্রিলিমিনারি পরীক্ষা ২৮ নভেম্বর। বলা হচ্ছে ২০০৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের সব কার্যক্রম শেষ হবে। আমরাও আশা করছি সেরকম। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সে পরীক্ষাতেও যে দুর্নীতি হবে না – কারচুপি হবে না তার গ্যারান্টি কী? দুর্নীতি করার সব সুযোগ বহাল রেখে শুধু মাত্র আশা করলেই কি সব হয়ে গেলো? মৌখিক পরীক্ষা এখনো পাস-ফেল নির্ভর। লিখিত পরীক্ষায়  ১০০% নম্বর পাবার পরও কাউকে মৌখিক পরীক্ষায় ফেল করানো সম্ভব। এবং তার জন্য ফেল করা পরীক্ষার্থীর আইনগত ভাবে কিছুই করার নেই। তিনি কিছুতেই প্রমাণ করতে পারবেন না যে তাঁকে ইচ্ছাকৃতভাবে ফেল করানো হয়েছে।

 

বিসিএস পরীক্ষায় মৌখিক পরীক্ষা বিষয়ে আমি একাধিক বার লিখেছি মনের তাড়নায়। বলেছি মৌখিক পরীক্ষার অংশটুকু রেকর্ড করে রাখা দরকার। তাতে পরীক্ষার্থী এবং পরীক্ষক উভয়ের কথোপকথনেরই রেকর্ড থাকবে। সবচেয়ে ভালো হতো যদি মৌখিক পরীক্ষার ব্যবস্থা তুলে দেয়া হতো। কারণ মৌখিক পরীক্ষায় প্রার্থীর সার্বিক যোগ্যতা যাচাই করা অসম্ভব। যদি প্রার্থীর ব্যক্তিত্ব বা সনদপত্র ইত্যাদি যাচাই করার জন্য সাক্ষাকার জরুরী হয়ে থাকে – তাহলে সেই সাক্ষাকারে কোন নম্বর থাকা উচিত নয়, পাস/ফেল থাকা উচিত নয়। তারপরও পিএসসি যদি মনে করে যে মৌখিক পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখতেই হবে – তাহলে অন্তঃত মৌখিক পরীক্ষায় আলাদা ভাবে পাশ করার ব্যবস্থাটুকু যেন তুলে নেয়া হয়। নইলে মৌখিক পরীক্ষার ফাঁদে ফেলে অপছন্দের কাউকে বাদ দেয়ার কাজ আগেও হয়েছে – ভবিষ্যতেও হবে।

 

বিসিএস মৌখিক পরীক্ষা সম্পর্কে আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথা একটু বলতে হয় এখানে। ষোড়শ বিশেষ বিসিএস পরীক্ষা ছিল সরকারী কলেজে প্রভাষক পদে নিয়োগের পরীক্ষা। পাস করবোই এরকম আত্মবিশ্বাস আমার ছিল। কারণ সে পরীক্ষায় প্রিলিমিনারী আর অনার্স ও মাস্টার্সে প্রাপ্ত নম্বর যোগ করার পর মৌখিক পরীক্ষায় পাস-ফেলের ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়ার কথা ছিল। অনার্স ও মাস্টার্সে যে নম্বর পেয়েছিলাম এবং প্রিলিমিনারী পরীক্ষা যেমন দিয়েছিলাম – তাতে মৌখিক পরীক্ষায় শুধুমাত্র পাস মার্ক পেলেও আমার বিসিএস পাস করার কথা। কিন্তু সেরকম হয়নি। মৌখিক পরীক্ষায় আমাকে কী কী প্রশ্ন করা হয়েছে এবং কেমন হেনস্তা করা হয়েছে তা নাইবা বললাম। আমার মত আরো অনেকের এই অভিজ্ঞতা আছে। একথা সবাই জানেন যে যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তখন সে সরকারের লোক পি-এস-সির কমিটিগুলোতে থাকেন। যখনকার কথা বলছি তখন বিএনপির হাত ধরে জামায়াত ক্ষমতায়। মৌখিক পরীক্ষায় আমাকে সাবজেক্ট ভিত্তিক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার চেয়ে প্রশ্নকর্তাদের বেশি উসাহ দেখা গেলো আমার ধর্মীয় পরিচয় আর বিশ্বাস প্রসঙ্গে। আমার মা-বাবা হিন্দু এটা হয়তো গ্রহণযোগ্য ছিল তাঁদের কাছে। কারণ আমি নিজের ইচ্ছায় জন্মাইনি। কিন্তু নিজের যুক্তিতেই আমি নাস্তিক। উপাসনা ধর্মে আমার অবিশ্বাস, সৃষ্টিকর্তার ধারণা আমার  কাছে অর্থহীন, অলৌকিক কোন কিছুর প্রতি প্রার্থনায় আমার বিশ্বাস নেই – এসব তাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য। রেজাল্ট বেরোলে দেখা গেল আমি ফেল। ইউনিভার্সিটির পরীক্ষায় সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে পাস করেও অনেকে বিসিএস পাস করে ফেললো, আর আমি ইউনিভার্সিটির পরীক্ষায় ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়েও বিসিএস পাস করতে পারলাম না! ইউনিভার্সিটি আমার মত একটা গাধাকে ফার্স্ট ক্লাস দিলো কীভাবে? এরকম ব্যাপার অহরহ ঘটছে বাংলাদেশে। সুতরাং আবার চেষ্টা। ১৯৯৮ সালে ১৮তম বিসিএস-এর মৌখিক পরীক্ষা দিলাম। তখন আওয়ামী সরকারের প্রথমার্ধ। শুয়েপড়া শিক্ষাব্যবস্থাকে কিছুটা হলেও উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করার চেষ্টা করা হচ্ছিল তখন। মৌখিক পরীক্ষায় তখন ব্যক্তিগত বিষয়ে কোন প্রশ্ন করা হয়নি দেখে খুব ভালো লেগেছিল। সে বিসিএস পরীক্ষায় আমি বেশ ভালো ভাবেই পাস করেছিলাম। তবে সরকারী চাকরি আমার করা হয়নি – কারণ নিয়োগ পাবার আগেই আমি মেলবোর্নে চলে এসেছিলাম উচ্চতর শিক্ষা নেয়ার জন্য। এই হলো বিসিএস পরীক্ষার সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক।

 

বিসিএস পরীক্ষা আমাদের মত নিম্ন সামর্থ্যের মানুষের জন্যও মাঝে মাঝে আশার আলো দেখায়। সবাই না হলেও একটা বৃহত্তর অংশ এখনো মেধাকে সম্বল করেই প্রতিযোগিতায় নামেন। তাই ব্যবস্থায় কিছুটা গলদ থাকলেও পুরো ব্যবস্থার প্রতি এতটা অবিশ্বাস আগে কখনো ছিল না। কিন্তু এখন বিসিএস পরীক্ষা হয়ে গেছে একটা লটারির মত। পরীক্ষাতো ভালো হতেই হবে – তারপরও কখন কী হবে কেউ জানে না। এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার। শুধুমাত্র আই-ওয়াশ করা নয়। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার মত পরিবর্তন দরকার। সে ব্যাপারে আমার একান্ত নিজস্ব কিছু প্রস্তাব আছে। প্রিলিমিনারী পরীক্ষায় যে নেগেটিভ মার্কিং এর ব্যবস্থা করা হয়েছে এবার থেকে – তাকে আমি স্বাগত জানাই। লিখিত পরীক্ষা যে রকম আছে সেভাবেই থাকতে পারে। মৌখিক পরীক্ষায় আলাদা ভাবে পাস করার বাধ্যবাধকতা তুলে নেয়া হোক। পরীক্ষা কার্যক্রমের দীর্ঘসূত্রিতা বন্ধ করা হোক। পরীক্ষার বিষয়ভিত্তিক প্রাপ্ত নম্বর প্রকাশ করা হোক। অকৃতকার্য পরীক্ষার্থীরও জানার অধিকার আছে কোন বিষয়ে কত পেলেন। কোটা-ব্যবস্থা সম্পর্কে স্বচ্ছ নীতি-মালা প্রকাশ করা হোক যাতে নিয়োগ প্রদানের বিষয়টি সবার কাছেই বোধগম্য হয়।

 

পুরো বিষয়টা নিয়ে যত সহজে লেখা যায়, প্রস্তাব করা যায় – তত সহজে কিন্তু প্রয়োগ করা যায় না। আমি আশা করি বিসিএস পরীক্ষায় আস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা দ্রুত করা হবে। ২৮তম বিসিএস পরীক্ষা হবে আস্থা ফিরিয়ে আনার পরীক্ষা। তারপর থেকে ব্যবস্থাটি আরো উন্নত থেকে উন্নততর হবে। কিন্তু কে জানে – হয়তো নতুন রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবার পেছনে হাঁটা শুরু হবে। জানি না। তবে এটুকু জানি – বিসিএস পরীক্ষা সম্পর্কে এটাই আমার শেষ লেখা। 

 

 

২৭ নভেম্বর ২০০৮

মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া