অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করতে এসেছিলাম ১৯৯৮ সালের জুলাই মাসে। তারপর আশা নিরাশা আনন্দ বেদনা আর ব্যস্ততায় দ্রুত কেটে যায় অনেকগুলো বছর। মেলবোর্ন শহরের পাশ দিয়ে যে ছোট্ট নদীটি বয়ে চলেছে তার নাম ইয়ারা। প্রবাস দিনে আমার কাছে এই ইয়ারাই হয়ে ওঠে কখনো কর্ণফুলি কখনো ইছামতি। ‘ইয়ারার তীরে মেলবোর্ন’ আমার প্রথম প্রবাসের প্রথম কয়েকটি দিনের স্মৃতিকথা।

০১
বুধবার ৮ জুলাই ১৯৯৮
ব্যাংকক ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট

বাংলাদেশ থেকে ব্যাংককের ভৌগোলিক দূরত্ব কত তুমি জানো? সময়ের দূরত্ব যে একঘন্টা তা এয়ারপোর্টের ঘড়ি দেখে বুঝতে পারছি। আমার ঘড়িতে এখন বিকেল পাঁচটা। এয়ারপোর্টের ঘড়িতে ছ’টা বেজে গেছে। টাইম এডজাস্ট করে নেয়া দরকার। কিন্তু ইচ্ছে করছে না। মেলবোর্নে গিয়ে তো আবার এডজাস্ট করতে হবে। মেলবোর্নের ফ্লাইট আটটা বিশে। এখনো দু’ঘন্টা সময় হাতে আছে।

ভেবেছিলাম দেশের বাইরে এসে যখন খুব মিস করবো তোমাকে, তখন লিখবো। কিন্তু সেটা যে এখনই শুরু হবে- ভাবিনি। মাত্র তিনঘন্টা হয়েছে তোমার কাছ থেকে এসেছি। অথচ মনে হচ্ছে এক যুগ কেটে গেছে।

১২ নম্বর গেটের কাছে বসে লিখছি। এ গেট দিয়েই আমাকে প্লেনে উঠতে হবে। ব্যাংকক থেকে মেলবোর্ন। প্ল্যান মাফিক প্লেন ভ্রমণ। একটু আগে প্ল্যানের একটি অংশ শেষ হয়েছে। ঢাকা থেকে ব্যাংকক। আরো কত দীর্ঘ এ প্ল্যান! যে যাত্রা আজ শুরু হলো – কতদূরে গিয়ে শেষ হবে আমি জানি না। একবার যখন বেরিয়ে পড়েছি মাঝপথে থেমে যাবার উপায় নেই। সলিল চৌধুরির গানের মতো করে আমি তো বলতে পারি না ‘এই রোখ রোখ, পৃথিবীর গাড়িটা থামাও, আমি নেমে যাবো’।

কিন্তু এ মুহূর্তে কী মনে হচ্ছে জানো? মনে হচ্ছে – ফিরে গেলে কেমন হয়? যদি ‘অপরাজিত’ সিনেমার অপুর ট্রেন ফেল করার মত প্লেন ফেল করে বাড়ি ফিরে যাওয়া যেতো! কিন্তু উপায় নেই। আমার টিকেট ওয়ান ওয়ে, নো রিটার্ন।

এই এয়ারপোর্টটি বিশাল। মনে হচ্ছে প্রকান্ড এক কাচের ঘরে বসে আছি। বাইরে অনেকগুলো বিমান উড়ার অপেক্ষায়। এত কাছ থেকে এতগুলো বিমান দেখা আজই প্রথম। ছোটবেলায় বিমানের শব্দ পেলেই আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠতাম – বোন্‌জান, বোন্‌জান। ‘ব্যোমযান’ শব্দটি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ঢুকে হয়ে গেছে বোন্‌জান। আজ সকালে ঢাকায় বিমান বন্দরে পা দেবার পর থেকেই শব্দটি মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। খুব ইচ্ছে করছে ছোটবেলার মত ‘বোন্‌জান’ ‘বোন্‌জান’ বলে চিৎকার করে উঠি। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে আনন্দ প্রকাশের স্বাধীনতা চলে যায়। নানারকম বাধা-নিষেধের বেড়াজালে আটকে পড়ে আমাদের আনন্দ-বেদনার প্রকাশভঙ্গি।

একদিন গ্রাম থেকে চট্টগ্রাম শহরে এসেছিলাম পড়ালেখা করে ‘মানুষ’ হবার জন্য। তারপর কেটে গেছে কত বছর। ইউনিভার্সিটির পড়ালেখা শেষ করে চাকরিও করলাম সাড়ে চার বছর এই শহরে। কিছুটা শিঁকড় তো গজিয়েছিল। গতকাল সকালে সে শিঁকড় ছিঁড়ে ট্রেনে উঠেছি। সুবর্ণ এক্সপ্রেস। ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে অঞ্জন, মৃণাল, সুব্রত, আর লিটন এসেছিল স্টেশনে বিদায় জানাতে। বিদায় দেয়া কষ্টের, বিদায় নেয়া আরো।

অজিত একটা গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে এসেছিল কমলাপুর স্টেশনে। সেখান থেকে হোটেল। তারপর মনে হচ্ছে নিমেষেই চলে গেলো সময়। আমার প্রিয় সব মানুষেরা সবাই এক সাথে আমার এত কাছে আগে কখনো থাকেনি। আর সেই সুখের সময়টি দেখতে না দেখতেই কেটে গেলো।

দুপুর বারোটার মধ্যেই এয়ারপোর্টে পৌঁছে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল সময়ের চাকায় উঠে পড়েছি। যেদিকে গড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে সেদিকেই যাচ্ছি। সময়ের কাছে কি আমরা বন্দী? দার্শনিকতা দেখানোর সময় এটা নয়। সেকারণেই হয়তো দার্শনিক সব প্রশ্ন মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে।

ডিপার্চার টার্মিনালে দাঁড়িয়ে ছিলেন নিউটনদা। নিউটনদা আমাদের ছোটবেলার হিরো। গ্রামে আমরা সব ছেলেরাই বড় হয়ে নিউটনদার মতো হতে চাইতাম। কত নতুন নতুন জায়গায় ঘুরে বেড়ান নিউটনদা । সেখান থেকে সুন্দর সুন্দর ভিউকার্ড পাঠান, চিঠি লেখেন। সেগুলো পেয়ে স্বপ্ন দেখতাম – একদিন আমিও–।

আজ এয়ারপোর্টে ডিউটি ছিলো না নিউটনদার। শুধুমাত্র আমার কারণেই এসেছেন। এয়ারপোর্ট ট্যাক্স জমা দেয়া, চেক ইন করা, বোর্ডিং পাস নেয়া সবকিছু তিনিই করে দিলেন।

একটু পরেই ইমিগ্রেশান এরিয়ার কাচের দরজা আমাকে বিচ্ছিন্ন করে দিলো আমার প্রিয়জনদের কাছ থেকে। তারা হাত নেড়ে কী বলছে আমি আর শুনতে পাচ্ছি না। আমার চোখ আমার সাথে প্রতারণা করতে চাইছে। কাল থেকে নিজের সাথে বোঝাপড়া করছি- একদম শক্ত হয়ে থাকবো, কোন কান্নাকাটি নয়। ফিরে তাকানোর প্রচন্ড ইচ্ছেটাকে চাপা দিয়ে এগিয়ে চলেছি নিউটনদার পিছু পিছু। কিন্তু পেছনে না তাকিয়েও বুঝতে পারছি আমাকে অনুসরণ করছে জোড়া জোড়া চোখ, আমার প্রিয় মানুষদের। তাদের ভালোবাসা আমার সাথে সাথে যাবে যেখানেই আমি যাই।

লিকলিকে ইমিগ্রেশান অফিসার বেশ গোমড়া মুখে তাকালেন আমার দিকে। পাসপোর্টের ছবির সাথে মিলিয়ে নিচ্ছেন আমাকে। চোখে মুখে বিরক্তির চিহ্ন স্পষ্ট। এ চাকরিটাই হয়তো বিরক্তিকর।
 “কোথায় যাচ্ছেন?”
 “অস্ট্রেলিয়া”।
পাসপোর্টে অস্ট্রেলিয়ান ভিসা যেখানে লাগানো আছে সেখানে চোখ লাগিয়ে দেখতে দেখতে প্রশ্ন করলেন, “ভিসা কোত্থেকে নিয়েছেন?”
 “অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশন থেকে”।
শুনে আরো গম্ভীর হয়ে গেলেন তিনি। অনেকক্ষণ কোন কথা বললেন না। একটা ছোট্ট টর্চলাইট বের করে ভিসা স্ট্যাম্পের উপর বিভিন্ন দিক থেকে আলো ফেলে পরীক্ষা করতে লাগলেন। নকল ভিসা নিয়ে যাচ্ছি কিনা পরীক্ষার পদ্ধতিটাকে খুব লাগসই মনে হলো না।
 “চাকরি করেন কোথাও?”
 “শাহীন কলেজে পড়াতাম। ছেড়ে দিয়েছি”।
 “তাদের ক্লিয়ারেন্স নিয়েছেন?”
ছাড়পত্রটা হাতের কাছেই ছিলো। এগিয়ে দিলাম তাঁর দিকে। তিনি একটু চোখ বুলিয়েই ফেরৎ দিলেন। এবার কী? এডমিশানের কাগজপত্র দেখতে চাইতে পারেন। স্কলারশিপের কাগজপত্র দেখতে চাইতে পারেন। সবকিছু আমার হাতেই আছে।

পেছনে অনেক যাত্রীর লম্বা লাইন। আমি একবার তাদের দিকে তাকালাম। সবাই খুব গম্ভীর। অফিসারের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার কোন উপায় নেই তিনি আমার ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। চোখেমুখে বিরক্তি লেগেই আছে। মনে হচ্ছে কোন ভুল খুঁজে না পেয়ে আরো বিরক্ত হয়ে গেছেন। ইমিগ্রেশান অফিসারদের মনে হয় বিরক্তি প্রকাশের ট্রেনিং নিতে হয়। হাসিমুখে ডিউটি করা কি ইমিগ্রেশান আইনে নিষেধ? পাসপোর্টটার বিভিন্ন পাতা উল্টেপাল্টে দেখার পর হঠাৎ ধাম ধাম করে দুটো সিল বসিয়ে দিলেন পাসপোর্ট আর বোর্ডিং কার্ডে। তারপর নিতান্ত অবহেলায় ঠেলে দিলেন আমার দিকে। অশেষ ধন্যবাদ।

এগিয়ে চলেছি নিউটনদার পিছু পিছু। তিনি আমাকে এয়ারপোর্টের কাজকর্মের বিবরণ দিচ্ছেন। বলছেন, “পৃথিবীর সব এয়ারপোর্ট বেসিক্যালি একই এভিয়েশান সিস্টেম মেনে চলে। নইলে এক দেশের বিমান অন্যদেশে অপারেট করতে পারতো না। যে কোন এয়ারপোর্টের টার্মিনালেই কোন্‌দিকে কী তা এরকম চিহ্ন দিয়ে দিয়ে দেখানো হয়। কেউ পড়তে না জানলেও কোন অসুবিধায় পড়বে না”। আমি হ্যাঁ হুঁ করে যাচ্ছি। কিন্তু মনে হচ্ছে কানে কিছুই ঢুকছে না। কেবল একটি শব্দই মাথার ভেতর বেজে চলেছে, বোন্‌জান বোন্‌জান।

এবার ফাইনাল সিকিউরিটি চেক। এটা পার হওয়ার পারমিশান নেই নিউটনদার। তিনি এখান থেকে বিদায় নিলেন। বললেন, টেক কেয়ার। আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোল না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। ততক্ষণে সিকিউরিটি অফিসাররা কাজ শুরু করে দিয়েছেন। হাতের ব্যাগ কাঁধের ব্যাগ সব চেক করা হলো। পকেটে হাত দিয়ে দেখা হলো। মেটাল ডিটেক্টার দিয়ে তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো। ঠিক কী খুঁজলেন আমি জানি না।

আরেকটি বড় রুমে বসে থাকতে হলো কিছুক্ষণ। কাচের দেয়ালের ওপাশে থাই এয়ারলাইন্‌স এর ফ্লাইট অপেক্ষা করছে। ব্যাংকক থেকে আসা যাত্রীদের চলে যেতে দেখলাম এই রুমের পাশ দিয়ে। একটু পরে বোর্ডিং শুরু হলো আমাদের। আমার জীবনের প্রথম ব্যোমযান থাই এয়ার লাইন্‌স এর ফ্লাইট TG-322।

বাংলা সিনেমার নায়ক-নায়িকারা প্লেনে উঠা-নামার সময় সিঁড়ি ব্যবহার করে। প্লেনের দরজায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ে, রুমাল নাড়ে। কিন্তু এখানে সেরকম কোন ব্যাপার ঘটলো না। মনে হলো একটা সুরঙ্গ পথ দিয়ে হেঁটে চলে এলাম প্লেনের দরজায়। হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে থাই তরুণী। দু’হাত জোড় করে নমষ্কার করছে যাত্রীদের।

প্লেনের ভেতর সম্পূর্ণ নতুন একটি জগত। মিষ্টি একটা গন্ধ চারদিকে। সবকিছু ঝকঝকে পরিষ্কার। আমার সিট 37A -জানালার পাশে। জানালা দিয়ে তাকানোর চেষ্টা করলাম টার্মিনালের দিকে। কাউকে দেখতে পাবার আশা অবান্তর। তবুও তাকিয়ে আছি। প্লেনের ডানা ছাড়িয়ে রানওয়ে পেরিয়ে টার্মিনালের দিকে – যার বাইরে রেখে এসেছি আমার সবকিছু। মনে পড়ছে একদিন প্রেমাকে বলেছিলাম, “তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও, এই বাংলার পরে আমি রয়ে যাবো”। এরপর প্রেমার সাথে দেখা হলে নিশ্চয় খোঁচা দেবে।

ঠিক দুটোয় প্লেনের চাকা ঘুরতে শুরু করলো। একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে টার্মিনাল। প্লেনের গতি বাড়ছে। একসময় প্রচন্ড বেগে ছুটে গিয়ে আকাশে উঠে গেলো। জানালার কাছে সাদা সাদা মেঘ দেখে হঠাৎ ভুলে গেলাম সবকিছু। এত সুন্দর আকাশ – এমন ঝকঝকে নীল। মেঘের সাদা আস্তরণ এখন কত নিচে।

আমার পাশে বসেছেন একজন বাংলাদেশী মহিলা। তাঁর দিকে তাঁকিয়ে একটু ভদ্রতার হাসি হাসলাম। তিনি পাত্তাই দিলেন না। হয়তো ভাবছেন উট্‌কো ঝামেলা। তাঁর দিকে তাকালেই তিনি দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছেন অন্যদিকে। হয়তো বুঝতে চেষ্টা করছেন সহযাত্রী হিসেবে আমি কতটা উপযুক্ত। মনে হচ্ছে তিনি আমাকে পাস-মার্ক দিলেন না। একটু পরেই উঠে চলে গেলেন প্লেনের পেছনের দিকে। আমার মুখ দেখেই হয়তো বুঝে গেছেন যে জীবনে এই প্রথম প্লেনে উঠেছি। নিয়ম-কানুন কিছুই জানি না, একটু প্রশ্রয় দিলেই হয়তো নানারকম প্রশ্ন করে বিরক্ত করবো।

একটু পরেই খাবার দেয়া হলো। সকালে দিদিদের অনেক সাধাসাধিতেও কিছু খেতে ইচ্ছে করে নি। আর প্লেনে খাবার দেখার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুধার্ত হয়ে গেলাম। যা পেলাম তা-ই খেলাম। ছুরি কাঁটাচামচ দিয়ে খেতে সামান্য অসুবিধা হলো। তাতে কিছু যায় আসে না। পাশের সিটের মহিলা উঠে যাওয়াতে আমার জন্য ভালোই হয়েছে। তিনি বসে থাকলে হয়তো অস্বস্তি লাগতো। অনেকে দেখলাম চিৎকার চেঁচামেচি করছে খাবার দেবার সময়। “এই যে সিস্টার, এদিকে, এদিকে” বলে বাংলায় ডাক দিচ্ছে হাত তুলে। থাই তরুণীরা বিরক্ত হলেও করার কিছু নেই। মুখটা হাসি হাসি করে রাখছে।

আমি অবাক হয়ে এদের পেশাদারী দক্ষতা দেখছিলাম। এয়ার হোস্টেজ হবার জন্য এদের নিশ্চয় অনেক ট্রেনিং নিতে হয়েছে। কত রকম মানুষের সাথে প্রতিদিন দেখা হচ্ছে, হাসিমুখে তাদের সামলাতে হচ্ছে। আবার নিজেদেরও নিশ্চয় সামলে রাখতে হচ্ছে নানারকম অন্যায় প্রলোভন থেকে।

লাঞ্চের পর প্লেনের ভেতর ব্যস্ততা কিছুটা বেড়ে গেলো। অনেকেই নিজের সিট ছেড়ে অন্যের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন। টয়লেটের কাছে লম্বা লাইন। এর মধ্যেই থাই বিমান-বালিকারা সবার এঁটো খাবার দাবার পরিষ্কার করে নিয়ে গেছে। কারো চা-কফি-মদ লাগবে কি না জিজ্ঞেস করছে। দেখলাম আমার বাংলাদেশী ভাইদের মধ্যে অনেকেই বেশ আয়েশ করে মদের পাত্রে চুমুক দিচ্ছেন। ব্যাংকক পৌঁছাবার আগেই তো এরা মাতাল হয়ে যাবে!

কিছুক্ষণ পর একটা সাদা ফর্ম দেয়া হলো। এম্বারকেশান ও কাস্টম্‌স ডিক্লারেশান। যারা থাইল্যান্ড যাচ্ছেন তাদের জন্য এটা পূরণ করা বাধ্যতামূলক। ইংরেজি আর থাই ভাষাতে ছাপানো ফরমটি উলটে পালটে দেখলাম। আমি থাইল্যান্ডে ঢুকছি না, তাই এই ফরম আমাকে পূরণ করতে হবে না। কিন্তু মেলবোর্নের ফ্লাইটে নিশ্চয় এরকম একটি অস্ট্রেলিয়ান ফরম দেয়া হবে। ভাবতে ভাবতে জানালায় চোখ রাখলাম।

বাইরে তাকিয়ে প্লেনের গতি বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে ঝকঝকে নীল আকাশে চুপচাপ ভেসে আছি। আইনস্টাইনের স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটি অনুসারে আর কোন রেফারেন্স ফ্রেমের সাথে তুলনা করা যাচ্ছে না বলেই গতি বোঝা যাচ্ছে না। টিভির পর্দায় দেখা যাচ্ছে প্লেন এগিয়ে চলেছে ঘন্টায় প্রায় নয়শ’ কিলোমিটার বেগে। কিন্তু আমার মন ছুটে চলেছে এর চেয়ে অনেক বেশি বেগে, পেছনের দিকে। কত চেষ্টা আর কষ্টের ফসল আজকের এই দিন। তবে এখনো বুঝতে পারছি না এ ফসল – ভালো না মন্দ।

আমার বাবা মাঝে মাঝে বাংলা মেশানো সংস্কৃতে একটা শ্লোক বলেন। যার অর্থ- অঋণী অপ্রবাসীই হলো সত্যিকারের সুখী মানুষ। সে হিসেবে সুখী হবার কোন রাস্তাই আমার খোলা নেই। আমি আকন্ঠ ঋণগ্রস্ত। মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির এক সেমিস্টারের টিউশন ফি থেকে শুরু করে প্লেনভাড়াটার জন্যও আমাকে ঋণ করতে হয়েছে। অর্থঋণ হয়তো শোধ হবে এক সময়। কিন্তু ভালবাসার ঋণ শোধ হয় না কিছুতেই।

“থ্যাংক ইউ ফর ট্রাভেলিং উইথ থাই এয়ারওয়েজ”- পাইলটের কথার এই শেষ লাইনটি ছাড়া আর কোন কিছুই কানে ঢোকেনি এতক্ষণ। প্লেন ব্যাংকক এয়ারপোর্টের কাছে আসতে না আসতেই শুরু হয়েছে এই ঘোষণা। আমার চোখ প্লেনের জানালায়, কাচের আবরণ পেরিয়ে আকাশের মেঘে, মেঘ ফুঁড়ে হয়তো আরো দূরে। কিছু দেখেছি বলে মনে হয় না, কেবল তাকিয়েই থেকেছি সারাটা সময়। মনে হচ্ছে একটা ঘোরের মধ্যে আছি।

রানওয়ের মাঝখানে থেমে গেছে প্লেন। সিটবেল্ট সাইন অফ হয়ে গেছে। যাত্রীরা প্রায় সবাই দাঁড়িয়ে গেছেন। ওভারহেড কেবিন খুলে যার যার ব্যাগ নিচ্ছেন। আমার দুটো ক্যাবিন ব্যাগ। দুটোই খুব ভারী। ভারী ব্যাগটা আরো ভারী করেছি এয়ারলাইন্‌সের দুটো ম্যাগাজিন নিয়ে। প্রায় সবাই বাংলায় কথা বলছেন। মনে হচ্ছে এখনো বাংলাদেশেই আছি। একজন সর্দার টাইপের লোক বেশ উচ্চস্বরে বলছেন, “শোনেন ভাইরা, এইটা ব্যাংকক এয়ারপোর্ট। এইটা এত বড় যে একটু এদিক ওদিক গেলেই হারাইয়া যাইবেন। তখন আবার সেই বাংলাদেশেই ফিরত যাইতে হইবো, দুবাই যাওয়া আর হইব না। এখন সিধা আমার পিছে পিছে আইয়া পড়েন”। এটা ঠিক কোন অঞ্চলের ভাষা বুঝতে পারছি না। সম্ভবত টিভি নাটকের জগাখিচুড়ি আঞ্চলিক ভাষা। সামনের দিকের মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়িয়ে তিনি বক্তৃতা দিচ্ছেন বলে পেছনের যাত্রীরা বেরোতে পারছেন না। একটু পরে সর্দার বেরিয়ে যেতেই তার পিছু পিছু নীল ড্রেস পরা পাঁচ-ছয় জন বেরিয়ে গেলেন। এদেরকেই হয়তো ঢাকা থেকে দুবাই নিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

প্লেনের দরজার সাথে সিঁড়ি লাগানো। নেমে এলাম রানওয়েতে। বেশ কিছু ছোটবড় প্লেন দাঁড়িয়ে আছে সামনের টার্মিনালের কাছে। প্রচন্ড গরম এখানে। মনে হচ্ছে আগুনের আঁচ লাগছে। এতক্ষণ প্লেনের ভেতর এয়ার কন্ডিশানে ছিলাম বলেই গরমটা একেবারে চামড়ায় বসে যাচ্ছে। সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে গার্ড টাইপের কয়েকজন হাত তুলে ইঙ্গিত করে দেখাচ্ছেন সামনের বাস।

বাসে ঠাসাঠাসি ভিড়, ভ্যাপসা গরম। রানওয়ের মাঝখান দিয়ে বাস এসে থামলো টার্মিনালের কাছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে টার্মিনালের পেছন দিকের একটি দরজা। এখানেও কাঁধে কালো স্ট্রাইপ আঁকা সাদা ইউনিফরম পরা এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি। ট্রাফিক পুলিশের মত হাত তুলে দেখাচ্ছেন কোন দিকে যেতে হবে।

সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলাম দোতলায়। মোজাইক করা ধবধবে মেঝে আলোয় ঝলমল করছে। একটু পর পর হলুদ সাইন দেখা যাচ্ছে। কোন কিছু খুঁজতে হলে সাইনগুলো দেখলেই বোঝা যাবে কোন দিকে যেতে হবে। নিউটনদার কথা কানে বাজছে, “পৃথিবীর সব এয়ারপোর্টই ধরতে গেলে একই নিয়মে চলে। একই রকম বোর্ডিং ব্রিজ, একই রকম এভিয়েশান সিস্টেম”।

আমার সাথে একই প্লেনে যারা এসেছেন তাঁদের বেশির ভাগই ব্যাংককের যাত্রী। দল বেঁধে চলে গেলেন ইমিগ্রেশানের দিকে। ওদিকেই ব্যাগেজ ক্লেম সাইন দেখা যাচ্ছে। আমাকে যেতে হবে অন্যদিকে। ট্রানজিট সাইন দেখতে দেখতে থাই এয়ারলাইন্‌সের কাউন্টারে এসে থামলাম। ডোমেস্টিক, ইন্টারন্যাশনাল সব কাউন্টারই খোলা। এখানে ওখানে সিলিং থেকে ঝুলছে টিভি মনিটর, বিভিন্ন ফ্লাইটের এরাইভ্যাল ও ডিপার্চার টাইম দেখানো হচ্ছে সেখানে। আমার কানেক্টিং ফ্লাইট টিজি৯৮১ – ছাড়ার কথা রাত সাড়ে আটটায়।

কাউন্টারে কর্মব্যস্ত থাই তরুণ তরুণীরা হাসিমুখে সামলাচ্ছে যাত্রীদের ভিড়। লাইনে আমার সামনের জনের কাজ মিটতেই এগিয়ে গেলাম।
 পাসপোত এন তিকেত প্লিজ!
থাই উচ্চারণে ইংরেজি শুনতে একটু অন্যরকম লাগে। হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে আমার পাসপোর্ট আর টিকেট নিয়েই কম্পিউটারের কি-বোর্ডে ঝড় তুলছে মেয়েটি। তাকে দেখতে চাকমাদের মত লাগছে। ফ্যাকাসে হলুদ গোলগাল মুখ, চ্যাপ্টা নাক আর ছোট ছোট চোখ।
 দু ইউ লাই উইন্দো অ আই?

আমি বুঝতে পারছি না মেয়েটি কী জানতে চাচ্ছে। তার অন্যরকম উচ্চারণ আর আমার ইংরেজি জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণেই এরকম হচ্ছে। বাক্যটি আরো কয়েকবার বলার পর বুঝতে পারলাম- “ডু ইউ লাইক উইনডো অর আইল”? জানালার সিট চাচ্ছি কি না জানতে চাচ্ছে। অবশ্যই জানালার পাশের সিট। একটু পরেই আমার নাম প্রিন্ট করা বোর্ডিং কার্ড নিয়ে ‘থ্যাংক ইউ’ বলে চলে এলাম।

কাউন্টারের একপাশে একটি ক্যাফে। সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে বেশ কিছু মানুষ। ক্যাফের পাশে ছোট্ট একটি রুমে কম্পিউটার গেম আর নানারকম ভেন্ডিং মেশিন। এর কোনটাই আমি আগে কখনো দেখিনি। নয়-দশ বছরের একটি বাচ্চা এসে মেশিনে কিছু কয়েন ঢুকিয়ে কিছু একটা করতেই একটা কোকের বোতল বেরিয়ে এলো মেশিন থেকে। ইচ্ছে করছিলো আমিও একবার চেষ্টা করে দেখি। কিন্তু আমার কাছে কোন থাই কয়েন নেই।

একটু সামনে গিয়ে দেখি ফ্লোরে চাদর বিছিয়ে শুয়ে বসে আছেন অনেকে। বাংলাদেশ থেকে আসা নীল পোশাকের মানুষদের দেখলাম ফ্লোরের একদিকে গোল হয়ে বসে নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। প্রত্যেকের চোখে-মুখে উদ্বেগের চিহ্ন সুস্পষ্ট। আমার দিকে তাকালে তারাও হয়তো সেরকম চিহ্নই দেখবেন আমার ভেতর। সবাই নিজের দেশ ছেড়ে বিদেশে যাচ্ছেন একটু উন্নত জীবনের আশায়। বিদেশে বেড়াতে যাওয়া মানুষ আর কাজ করতে যাওয়া মানুষের মধ্যে কত পার্থক্য। যারা বেড়াতে যান তাদের চোখে-মুখে থাকে উৎসাহ আনন্দের চিহ্ন। আর যারা কাজ করতে যান তাদের থাকে উদ্বেগ। এই লাউঞ্জে যারা বসে আছেন, তাদের চেহারা দেখেই বলে দেয়া যায় কে কোন্‌ কারণে যাচ্ছেন।

লাউঞ্জের মাঝে মাঝে বেশ কয়েকটি টিভি। সি-এন-এন চ্যানেল চলছে। দু’পাশে বেশ কিছু দোকান। গিফ্‌ট শপ, ফ্রুট শপ, ফুট-মাসাজ। ফুট-মাসাজ পার্লারে ছোট ছোট বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছেন অনেকে, আর তাদের পদসেবা করছে কিছু থাই তরুণী।

আমাকে যেতে হবে ১২ নম্বর গেটে। হলুদ সাইন দেখে বুঝতে পারছি- যেতে হবে তিনতলায়। দোতলা থেকে তিনতলায় উঠার সিঁড়ির বাম পাশে ইমিগ্রেশান অফিসারদের ঘর। এখান থেকে অন দ্যা স্পট ভিসাও ইস্যু করা হয়। কয়েকজন অলস থাই পুলিশ দেখলাম সেখানে – পেট-মোটা গম্ভীর।

লোহার গেট পেরিয়ে বামদিকে গেলেই তিনতলায় উঠার চলমান সিঁড়ি। তারপাশে এমনি সিঁড়িও আছে। জীবনে প্রথম এস্কেলেটরে পা রাখলাম। একদিনেই অনেক নতুন ব্যাপার ঘটে যাচ্ছে আজ।

তিনতলায় উঠে হকচকিয়ে গেলাম। মনে হচ্ছে বিশাল এক শপিং সেন্টারে ঢুকে পড়েছি। অসংখ্য যাত্রীর আনাগোনা। ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে কেউ হাঁটছে, কেউ ছুটছে। আমার কাঁধের ব্যাগটা অসম্ভব ভারী মনে হচ্ছে এখন। প্রায় সবার ব্যাগেই দেখি চাকা লাগানো আছে। তরতর করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এরকম চাকাওয়ালা ব্যাগও এর আগে দেখিনি আমি। আসলে তেমন কিছুই তো দেখার সুযোগ আমার ঘটেনি। আমাদের চৌদ্দগোষ্ঠীতে আমরাই একটু পড়ালেখা করার সুযোগ পেয়েছি। আমার আগে দিদি দেশের বাইরে গেছে একবার – জাপানে। আমারতো তবু একটা চলনসই ব্যাগ কাঁধে আছে। দিদি গিয়েছিলো একটি চটের থলে হাতে নিয়ে।

স্ট্যান্ড থেকে ট্রলি নেবো কিনা ভাবছি। ট্রলির জন্য টাকা দিতে হয় কিনা জানি না। কাউকে জিজ্ঞেস করতেও সংকোচ হচ্ছে। একজন যাত্রী ট্রলি-স্ট্যান্ড থেকে বেশ দূরে একটি ট্রলি ফেলে গেলো। আমি সেটা দখল করলাম। কাঁধের বোঝা হালকা হওয়াতে কিছুটা ভালো লাগছে। হলুদ সাইন দেখতে দেখতে এগোচ্ছি ১২নং গেটের দিকে। দু’পাশে অসংখ্য মনোহারি দোকান। স্থায়ীদোকানের পাশাপাশি অনেকগুলো অস্থায়ী দোকান। চাকা লাগানো দোকান গুলো মনে হচ্ছে ঠেলে ঠেলে নিয়ে যায় যেদিন যেখানে খুশি। বেশির ভাগ দোকানীই অল্পবয়সী মেয়ে।

১২নং গেটে যাবার জন্য এদিক থেকে আবার দোতলায় নামতে হলো। এখানে ট্রলি নিয়ে যাওয়া নিষেধ। ব্যাগ দু’টো কাঁধে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতেই সিকিউরিটি চেক। তেমন ভীড় নেই এদিকে।

ইন্সপেক্টর টাইপের একজন ছেলে বসে আছে বিরাট স্ক্যানারের সামনে। আর মেটাল ডিটেক্টর লাগানো গেটের কাছে হাত খানেক লম্বা কালোমতন একটি যন্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছেন একজন মহিলা। কোমরের বেল্ট, ঘড়ি, চশমা সব খুলে প্লাস্টিকের ঝুড়িতে রাখতে হলো। দুপুরে ঢাকা এয়ারপোর্টের সিকিউরিটি পার হবার সময় এসব খুলতে হয়নি। সেখানেও মেটাল ডিটেক্টর ছিল, কিন্তু চেক করা হয়েছে সারাগায়ে হাত বুলিয়ে।

মেটাল ডিটেক্টরের ভেতর দিয়ে হেঁটে এলাম। কোন শব্দ হলো না। স্ক্যানারের ভেতর থেকে আমার ব্যাগ বেরিয়ে এলো। ইন্সপেক্টর ছেলেটার ইচ্ছে হলো আমার ব্যাগদুটো খুলে দেখবে। ধীরে সুস্থে ব্যাগ খুলে এদিক ওদিক হাত ঢুকিয়ে চেক করছে। মহিলা ইন্সপেক্টর হাতের যন্ত্রটি আমার শরীরের কাছে এনে দেখছেন কোন শব্দ হয় কিনা। মনে হচ্ছে এ কাজটি করতে খুব মজা পাচ্ছেন তিনি। নিজেদের ভাষায় কথা বলতে বলতে একটু পর পর হেসে উঠছেন। আমাকে নিয়ে মজা করছেন কিনা জানিনা। করলেও করতে পারেন। আমাদের দেশ সম্পর্কে থাইদের ধারণা কীরকম জানি না, তবে মনে হচ্ছে খুব একটা সম্মানজনক নয়।

একটু পরেই ‘ও-কে’ বলে ছেড়ে দিলো আমাকে। ‘থ্যাংক ইউ’ বলে আস্তে আস্তে এসে বসেছি এখানে। গেটের কাছে কাউন্টার খুলেছে। আস্তে আস্তে ভীড় বাড়ছে। যে ভদ্রমহিলা ঢাকা থেকে আসার সময় প্লেনে আমার পাশের সিট থেকে উঠে গিয়েছিলেন তাঁর সাথে চোখাচোখি হতেই তিনি মুখটা কঠিন করে চোখ সরিয়ে নিলেন। মনে হচ্ছে এখানেও আমাকে দেখে তিনি খুব বিরক্ত। তাঁর নাম দেয়া যাক বিরক্তি বেগম। বিরক্তি বেগমের বিরক্তি দেখে আমার খুব মজা লাগছে। আচ্ছা তাঁর এ বিরক্তির কারণ কী বলতে পারো?

আকাশের মাঝখানে কোথাও
রাত নিঝুম, চাঁদের আলোর বান ডেকেছে

আকাশের সীমানা কীভাবে ভাগ করে জানি না। প্লেনের সিটে লাগানো ছোট টেলিভিশনের মত যন্ত্রটাতে দেখতে পাচ্ছি প্লেন অস্ট্রেলিয়ার সীমান্তে ঢুকছে। কিন্তু ঠিক বুঝতেও পারছি না কোথায় আছি। ভূমি থেকে সায়ত্রিশ হাজার ফুট উচ্চতায় আছি। বাইরের তাপমাত্রা মাইনাস চল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস। স্কুলে ফিজিক্সের একটি অংক খুব মজা করে করতাম। কোন্‌ তাপমাত্রায় সেন্টিগ্রেড ও ফারেনহাইট স্কেল সমান? উত্তরটা মনে পড়লো মাইনাস চল্লিশ ডিগ্রি দেখে। এত ঠান্ডা আকাশ! আজ মনে হয় পূর্ণিমা। আকাশ ভরা চাঁদের আলো। কেমন যেন কুয়াশা মাখা। অথচ এত উঁচুতে কুয়াশা থাকার কথা নয়। বাতাসের ঘনত্ব তো খুবই কম হবার কথা এখানে। সারা প্লেন ঘুমাচ্ছে। আমার পাশের দুটো সিট খালি। বেশ আরাম করে একটা ঘুম দিয়ে উঠেছি। আমার কব্জিতে এখনো তোমার সময়। রাত ১২টা পঞ্চাশ। মনে হচ্ছে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে গত কয়েক ঘন্টায়। বলছি তোমাকে।

বোর্ডিং কার্ড হাতে নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। সামনের ভদ্রলোক হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে বললেন, “গরম জামা-কাপড় কিছু আনোনি? কেউ বলে দেয় নি যে অস্ট্রেলিয়াতে খুব ঠান্ডা এখন?”

অস্ট্রেলিয়াতে এখন যে শীতকাল তা আমাকে কে বলবে? ব্যাগে একটা সোয়েটার আছে। উদয়দা নিজের ব্যবহারের জন্য এনেছিলেন ইন্ডিয়া থেকে। আমাকে দিয়ে দিয়েছেন। ওটা বের করে পরে নিলেই হবে। বললাম, খুব বেশি ঠান্ডা পড়ে নাকি স্যার?

ভদ্রলোকের বয়স খুব একটা বেশি হবে না। তাঁর সুট-কোট দেখেই হোক, কিংবা আমাকে তুমি তুমি করছেন দেখেই হোক মুখ দিয়ে ‘স্যার’ বেরিয়ে গেল। মনে হলো তাতে ‘স্যার’ খুশিই হলেন। জিজ্ঞেস করলেন, “পড়াশোনা করতে যাচ্ছো? সিডনিতে?”
– “জ্বি। সিডনিতে না, মেলবোর্নে”।
আমি একটু সমস্যায় পড়ে গেলাম। এই প্লেন কি সিডনি যাচ্ছে? আমি তো মেলবোর্নে যাচ্ছি। সিডনিতে কি আমাকে প্লেন বদলাতে হবে? আমার টিকেটে এবং বোর্ডিং কার্ডে তো মেলবোর্নই লেখা আছে।
– “স্যার, আমি তো মেলবোর্নে যাচ্ছি। এই প্লেন কি সিডনি যাবে? তাহলে মেলবোর্নে যাবো কীভাবে?”
– “আই ডোন্ট নো। তুমি কাউন্টারে জিজ্ঞেস করো”।

ভদ্রলোকের সামনে দু’জন শ্বেতাঙ্গ। তাদের সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন বিরক্তি বেগম। বার দুয়েক পেছন ফিরে তাকালেন। আমাকে দেখলেই তাঁর মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে – অথচ আবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছেন এটাই আশ্চর্যের। হয়তো আমাদের কথোপকথন তাঁর কানে গেছে। তিনি নিশ্চয় মেলবোর্নে যাচ্ছেন না। গেলে আমার প্রশ্ন শুনে নির্বিকার থাকতেন না। লাইন থেকে বেরিয়ে কাউন্টারে গিয়ে থাই মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম – সিডনিতে গিয়ে প্লেন চেঞ্জ করতে হবে কি না। সে বললো- না, প্লেন চেঞ্জ করতে হবে না। সিডনিতে গিয়ে প্লেন থামবে। তারপর একই প্লেন আবার মেলবোর্নে যাবে। যাক্‌, ভালোই হলো। সিডনি এয়ারপোর্টটাও দেখা হয়ে যাবে।

প্লেনে উঠে আমার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসার জোগাড়। প্লেন যে এত বড় হতে পারে ভাবিনি। বোয়িং ৭৪৭। প্রায় সাড়ে চারশ’ মানুষ নিয়ে উড়তে পারে। আমার সিট নাম্বার 60K। একটু পেছনের দিকে জানালার পাশে। পাশের দুটো সিট 60I ও 60J খালি। চোখের সামনে ছোট্ট টেলিভিশন স্ত্রিন। সব মিলিয়ে কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। যথাসময়ে প্লেন ছাড়লো। শূন্যে উঠে যাবার একটু পরেই খাবার দেয়া হলো। থাই পোশাক পরা এয়ার হোস্টেজরা যাত্রীদের প্রয়োজন মেটাতে ব্যস্ত। পাশের দুটো সিট খালি হওয়াতে বেশ আরাম হলো আমার। পেটভর্তি করে খেলাম। চকলেট, কেক কতকিছু দিয়েছে। সব শেষ করতে পারলাম না। কিছু ব্যাগে নিয়ে নিয়েছি। পরে কাজে লাগবে। সামনের টিভিতে বিশ্বকাপ ফুটবলের কিছু অংশ দেখাচ্ছে। খেলার দিকে মনযোগ নেই আমার। আরেকটি চ্যানেলে ‘দি নিউ এডভেঞ্চার অব সুপারম্যান’ দেখাচ্ছে। কোন প্রোগ্রামেই মন দিতে পারছি না। কম্বল মুড়ি দিয়ে তিনটি সিটে লম্বা হয়ে দিলাম ঘুম।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। চোখ বন্ধ করতেই স্বপ্নের মত ভেসে এসেছে ফেলে আসা কত ঘটনা কত স্মৃতি। আমার প্রিয় সব মানুষেরা। হাত বাড়াতেই স্বপ্নভাঙা ছন্দপতন। চোখ মেলে দেখি আবছা আলোয় প্রায় সবাই ঘুমুচ্ছে। জানালার আবরণ একটু তুলতেই জোছনার প্লাবন। সাঁয়ত্রিশ হাজার ফুট উঁচুতে বায়ুযানে ভেসে যাচ্ছি ঘন্টায় নয়শো কিলোমিটার স্পিডে। অনেক নিচে মেঘের আস্তরণ জোছনার আলোতে শাদা। কত গ্রাম কত নদী কত পাহাড় পেরিয়ে যাচ্ছে আমাদের থাই এয়ার-ওয়েজের ফ্লাইট TG981।

আস্তে আস্তে ভোর হয়ে যাচ্ছে। অথচ ঘড়িতে এখনো মধ্যরাত্রি। রোদ উঠলো। কী চমৎকার সোনালী আলো – সাদা মেঘের উপর পিছলে পড়ছে। প্লেন অনেক নিচে নেমে এসেছে। মেঘের নিচে নীল রেখার মতো একটি নদী। কী নদী কে জানে।

কেবিন ক্রুরা একটি ফরম দিল পূরণ করার জন্য। কাস্টম্‌স ডিক্লারেশান ফরম। টিভিতে দেখানো হচ্ছে ফরমটি কীভাবে পূরণ করতে হব, অস্ট্রেলিয়া খাদ্যদ্রব্য সম্পর্কে খুবই স্পর্শকাতর। কোন ধরণের খাবার সাথে থাকলে তা ডিক্লেয়ার করার কথা বলা হচ্ছে। দুগ্ধজাত বা ফলমূল হলে তা ফেলে দিতে বলা হচ্ছে। প্লেনের কোন খাবার যেন সাথে না থাকে। আমি প্লেনে দেয়া যে খাবারগুলো ব্যাগে ভরে নিয়েছিলাম – বের করে নিলাম। দু’ডলারের খাবারের জন্য একশ ডলার ফাইন দেয়ার সামর্থ্য আমার নেই।

প্লেন আরো নিচে নেমে এলো। মনে হচ্ছে ঘাসের উপর দিয়ে উড়ে চলেছি। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম- ঘাস নয়। ঘন সবুজ বিরাট বিরাট গাছ। একটু পরেই সবুজ ঘাসের চাদর। আর যেন সেই চাদরের ওপর মসৃণভাবে নেমে এলো আমাদের বায়ুযান। প্লেন সিডনি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করলো। এখানে সবাইকে নেমে যেতে হবে। আবার এই প্লেনেই উঠবো। রাখছি এখন।

চলবে—-