বিজ্ঞানে দু’ধরনের জিনিয়াস দেখা যায় – অর্ডিনারি জিনিয়াস ও ম্যাজিশিয়ান জিনিয়াস। অর্ডিনারি জিনিয়াস অনেকেই হতে পারেন যদি সেরকম চেষ্টা, উদ্যম, অধ্যবসায় এবং সুযোগ থাকে। একজন অর্ডিনারি জিনিয়াসের চিন্তায় ও কাজে তেমন কোন রহস্য থাকে না যদি জানা যায় তাঁরা কী করেছেন এবং কীভাবে তা করেছেন। তখন এমনও মনে হতে পারে যে চেষ্টা করলে আমরাও হয়তো তা করতে পারি। কিন্তু ম্যাজিশিয়ান জিনিয়াসের ক্ষেত্রে এটা খাটে না। তাঁদের কাজের ফল দেখা যায়, কিন্তু কীভাবে কাজটা হলো তা দেখার পরেও, সমস্ত রকমের সুযোগ সুবিধা কাজে লাগিয়েও আমাদের পক্ষে তা করা সম্ভব হয় না। রিচার্ড ফাইনম্যান ছিলেন উচ্চতম পর্যায়ের জাদুকর জিনিয়াস – বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ডায়নামিক পদার্থবিজ্ঞানী।

১৯১৮ সালের ১১ মে আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরে জন্মগ্রহণ করেন রিচার্ড ফাইনম্যান। একুশ বছর বয়সে ১৯৩৯ সালে ম্যাচাচুসেস্ট ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এম-আই-টি) থেকে বিএসসি। প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ১৯৪২ সালে। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন পৃথিবীর প্রথম পারমাণবিক প্রকল্প ম্যানহাটান প্রজেক্টে হিউম্যান কম্পিউটার হিসেবে। কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন ১৯৪৫ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত। তারপর ১৯৫০ থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অধ্যাপনা ও গবেষণা করেছেন ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (ক্যালটেক)-এ। কোয়ান্টাম ইলেকট্রো-ডায়নামিক্স এর অন্যতম জনক তিনি। ১৯৬৫ সালে এই কাজের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন তিনি। যে ন্যানো-টেকনোলজির প্রয়োগ এখন ওষুধ থেকে শুরু করে জীবনের হাজারো ক্ষেত্রে সেই ন্যানো-টেকনোলজির প্রাথমিক ধারণার উৎপত্তি ফাইনম্যানের হাতে। মৌলিক কণার ক্রিয়া-কলাপ নিঁখুত ভাবে হিসেব করার একটা কার্যকরী পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন তিনি যা ফাইনম্যান-ডায়াগ্রাম নামে চেনে সবাই। পদার্থবিজ্ঞানের এমন কোন শাখা নেই যেখানে ফাইনম্যান উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন নি। পদার্থবিজ্ঞানের জগতে ফাইনম্যানের মত এমন ভালো শিক্ষক আর কখনো পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে ক্লাসিক টেক্সট বইয়ের নাম ‘ফাইনম্যান লেকচার অন ফিজিক্স’ যা রচিত হয়েছে তাঁর ক্যালটেকের ক্লাসরুমে দেয়া লেকচারগুলো থেকে। আইনস্টাইনের পরে ফাইনম্যানই ছিলেন বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে সৃষ্টিশীল বহুমাত্রিক পদার্থবিজ্ঞানী।

ছোটবেলা থেকেই বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা নিয়ে বড় হয়েছেন রিচার্ড। শৈশবেই তাঁর বাবা মেলভিল ফাইনম্যান তাঁর ভেতর বিজ্ঞানের প্রতি ভালবাসার বীজ রোপন করে দিয়েছিলেন। স্কুল বাড়ি সবখানেই নানারকম পর্যবেক্ষণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে করতে শিখতে শিখতে মুক্ত চিন্তার স্বাধীন পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন রিচার্ড ফাইনম্যান। স্কুলের নিচের ক্লাসে থাকতেই লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে এসে নিজে নিজে শিখে ফেলেছেন বীজগণিত, ক্যালকুলাস, ত্রিকোণমিতি।

দুর্ধর্ষ মেধা ও ক্ষুরধার বুদ্ধির পাশাপাশি অত্যন্ত সুদর্শন ছিলেন রিচার্ড ফাইনম্যান। স্বাভাবিক ভাবেই স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন অনেকে। তাদের মধ্যে তাঁর মেধা ও বৈজ্ঞানিক দক্ষতার মূল্য কতখানি তা বোঝার ন্যূনতম যোগ্যতা যাদের ছিল না তারাও ছিলেন।

অন্য দশজন স্বাভাবিক কিশোরের মতই কৈশোরে মেয়েদের প্রতি বিশেষ টান অনুভব করেছে রিচার্ড। বারো বছর বয়সেই সে আকৃষ্ট হলো তার ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটির দিকে। ফার রকওয়ে হাইস্কুলে ক্লাস এইটে পড়ে তখন তারা। ক্লাসে বসার জায়গা নির্দিষ্ট করে দেয়া আছে। পদবীর আদ্যাক্ষর অনুসারে বেঞ্চ। রিচার্ডের সিট এফ অনুসারে সামনের দিকে। মেয়েটির পদবীর আদ্যাক্ষর ‘আর’ – বসে পেছনের দিকের বেঞ্চে। ইতিহাসের ক্লাসে রিচার্ড উঠে মেয়েটির পাশে গিয়ে বসলো। স্যারের চোখ এড়ালো না।
“ফাইনম্যান, তুমি ওখানে কেন?”
“আমার সিট থেকে ভাল শোনা যায় না স্যার।”
“সামনের চেয়ে পেছনে ভাল শোনা যায়?”
“আপনি স্যার কথা বলতে বলতে প্রায় সময়েই পেছনের দিকে চলে যান তো, তাই।”
উপস্থিত বুদ্ধির জোরে ইতিহাস স্যারের কাছে রেহাই পেলেও মেয়েটি তার প্রতি কোন আগ্রহ দেখালো না। রিচার্ডের তাতে কিছু যায় আসে না। সে আরেক জনের দিকে মনযোগ দিল।

স্কুলে সিনিয়র ক্লাসের ছেলেদের অংক করে দিত রিচার্ড। ফলে সিনিয়রদের সাথেও বন্ধুত্ব হয়ে গেছে তার। তারা রিচার্ডকে অনেক নিষিদ্ধ বিষয়ে জ্ঞান দিতো। অনেক মেয়ের সাথে পরিচয় ছিলো তাদের। অন্য স্কুলের মেয়েদের সাথেও তারা বেড়াতে যেতো বিভিন্ন জায়গায় – সমুদ্রের ধারে, সৈকতে। রিচার্ডও মাঝে মাঝে যেতো তাদের সাথে।

একদিন তারা সবাই মিলে সৈকতে হাঁটছে। ছেলেদের অনেকেই মেয়েদের নিয়ে জেটির দিকে চলে গেছে। একটা মেয়ের প্রতি রিচার্ডের সামান্য দুর্বলতা দেখা যাচ্ছিলো। মেয়েটার কথা ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে “বারবারাকে নিয়ে সিনেমায় গেলে কেমন হয়?” তার পাশে যে ক’জন বন্ধু ছিল সবাই হৈ হৈ করে উঠল। একজন দৌড় লাগালো জেটির দিকে এবং মুহূর্তে বারবারাকে খুঁজে বের করে চিৎকার করে বলতে লাগলো, “ফাইনম্যান তোমাকে কিছু বলতে চায় বারবারা। ফাইনম্যান তোমাকে -”
রিচার্ড লজ্জা পেয়ে গেল। অল্পক্ষণের মধ্যেই ছেলেরা সব তার চারপাশে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো, “এবার বলো ফাইনম্যান, বলো বারবারাকে কী বলতে চাও। বলো ফাইনম্যান, বলো ফাইনম্যান”
জেদ চেপে গেল রিচার্ডের। সে সবার সামনে বারবারাকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যাবার প্রস্তাব দিল। ওটা ছিল তার জীবনের প্রথম ডেটিং। তার বয়স তখন মাত্র তেরো।

মায়ের সাথে খুব অন্তরঙ্গ রিচার্ড। মা-কে বললো বারবারাকে নিয়ে সিনেমায় যাবার পরিকল্পনার কথা। মা তাকে গুচ্ছের উপদেশ দিতে শুরু করলেন। ডেটিং-এ কী কী করতে হয়, কীভাবে করতে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। মা জানতে চান, “যাবি কীভাবে?”
“বাসে”
“বাসে ওঠার সময় তাকে আগে উঠতে দিবি। নামার সময় তুই আগে নামবি। নিচে নেমে বারবারার দিকে হাত বাড়িয়ে দিবি যেন সে তোর হাত ধরে নামতে পারে।”
“তারপর?”
“ফুটপাত দিয়ে হাঁটার সময় তুই থাকবি রাস্তার দিকে।”
মা তাকে ডেটিং-এ গেলে কী কী কথা বলতে হবে তাও বলে দিলেন। সেই সময়টাতে ছেলেমেয়েদের ডেটিং-এ পাঠানোও ছিল যেন অনেকটা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ।

ডিনারের পরে রিচার্ড মোটামুটি সেজেগুঁজে গেলো বারবারাকে ডাকতে তাদের বাড়িতে। ইতোমধ্যেই সে খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছে। বারবারা তখনো রেডি হয়নি। রিচার্ডকে অপেক্ষা করতে হলো বারবারাদের ডাইনিং রুমে। মরার উপর খাড়ার ঘা, বারবারাদের ডাইনিং রুম ভর্তি গেস্ট – খাচ্ছেন আর গল্প করছেন। সবাই দেখছেন রিচার্ডকে। কেউ কেউ বলছেন, “ছেলেটা কিউট না?”

রিচার্ডের মনে হচ্ছিলো এরকম যন্ত্রণায়ও পড়ে মানুষ? ডেটিং এ যাবার এরকম ফর্মালিটির প্রতি তার বিরক্তির শুরু সেখান থেকে।
বারবারাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তারা গেলো সিনেমা থিয়েটারে। হাঁটতে হাঁটতে গল্প করছিলো। রিচার্ড কথা বলতে পছন্দ করে। সে তার পিয়ানো বাজানোর অভিজ্ঞতা বললো বারবারাকে – “ছোটবেলায় একবার পিয়ানো বাজানো শিখতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু ছয় মাস শেখার পরেও যখন ড্যান্স অব দি ডেইজিস ছাড়া আর কিছু বাজাতে পারলাম না – ছেড়ে দিলাম। ঐটুকুও আমার জন্য বেশি ছিল।”
বারবারা সম্ভবত পিয়ানো খুব ভাল বাজায়। সে কিছুই না বলে মিটিমিটি হাসতে লাগলো। তারা ছবি দেখলো। তারপর বারবারাকে তাদের বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসার সময় হঠাৎ মনে পড়লো তার মা বলেছিলেন বারবারার পোশাকের প্রশংসা করতে। এটা করা উচিত ছিলো বারবারাকে দেখার সাথে সাথে। কিন্তু বেটার লেট দ্যান নেভার। রিচার্ড ভালো করে তাকালো বারবারার দিকে। প্রশংসা করার মত তেমন কিছুই দেখলো না। বললো, “তোমার দস্তানাগুলো খুবই সুন্দর বারবারা।”
বারবারা এবারো কিছুই বললো না। রিচার্ড বুঝতে পারছে বারবারার সাথে এটাই শেষ ডেটিং। বললো – “গুড নাইট বারবারা।”
বারবারা মিষ্টি হেসে বললো, “এই চমৎকার সন্ধ্যাটার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।”
রিচার্ডের বেশ ভালো লাগলো কথাগুলো। “ইউ আর ওয়েলকাম” বলে বেশ ফূর্তি নিয়ে বাড়িতে চলে এলো রিচার্ড।

বারবারার মধ্যে ভাল লাগার মত কিছুই খুঁজে পেলো না রিচার্ড। কিছুদিন পরে সে ডেটিং-এ গেলো আরেকটি মেয়ের সাথে। একই পদ্ধতিতে সময় কাটিয়ে বাড়ি ফেরার সময় যখন তাকে ‘গুডনাইট’ বললো সেই মেয়েটিও বললো, “এই চমৎকার সন্ধ্যাটার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।”
চমকে উঠলো রিচার্ড। হুবহু একই সংলাপ! তবে কি মেয়েরাও তালিম নিয়ে আসে?
তৃতীয়বার যখন অন্য আরেকজনের সঙ্গে সারা সন্ধ্যা কাটিয়ে বিদায় নিচ্ছিলো রিচার্ড দেখলো সে ‘গুড নাইট’ বলার সাথে সাথে মেয়েটি মুখ খুলতে শুরু করেছে। সে তাকে সুযোগ না দিয়ে নিজেই বলে ফেললো, “এই চমৎকার সন্ধ্যাটির জন্য তোমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।” মেয়েটি থতমত খেয়ে গেলো।

একদিন একটা পার্টিতে আড্ডা মারছিল রিচার্ড তার বন্ধুদের সাথে কিচেনে বসে। তারচেয়ে বয়সে বড় একজন তাদের শিখাচ্ছিলো কীভাবে চুমু খেতে হয়। তার গার্লফ্রেন্ডকে সাথে নিয়ে সে দেখাচ্ছিলো – “তোমার ঠোঁটদুটোকে রাখতে হবে এভাবে সমকোণে যেন নাকে নাকে সংঘর্ষ না ঘটে” ইত্যাদি ইত্যাদি যা জানা ছিল তার।

রিচার্ড কিছুদূর শেখার পরে বসার ঘরে গিয়ে পরিচিত এক মেয়েকে খুঁজে বের করে সোফায় বসে সদ্যশেখা কিসিং আর্টের চর্চা করতে শুরু করলো।
হঠাৎ যেন সবাই খুব চঞ্চল হয়ে উঠল। কেউ কেউ চিৎকার করে বলছিল – “আরলিন আসছে, আরলিন, আরলিন।”
রিচার্ড বুঝতে পারছিলো না আরলিন কে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শোনা গেল, “এই তো এসে গেছে আরলিন। হাউ বিউটিফুল শি লুক্‌স।” দেখা গেলো এক নিমিষে সবাই যে যা করছিল সব ফেলে আরলিনকে দেখার জন্য ছুটে গেল।

রিচার্ড ভাবলো আরলিন হয়তো খুব সুন্দরী কোন মেয়ে তাই ছুটছে সবাই এভাবে। কিন্তু সব কাজ ফেলে কোন মহারানিকে দেখতে ছুটে যাবার বিষয়টা তার কাছে অগণতান্ত্রিক মনে হল। সে তাই কোন কৌতূহল না দেখিয়ে যা করছিল তাই করতে থাকলো।
এর কিছুদিন পরে যখন আরলিনের সাথে পরিচয় হলো তখন আরলিন তাকে বলেছিলো সেই পার্টির কথা – “সব প্রাণবন্ত মানুষ আমাকে দেখতে গেল, আমার সাথে কথা বলল। অথচ একটা ছেলে এক কোণায় বসে একটা মেয়ের সাথে এমন মগ্ন ছিল যে আমার দিকে ফিরেও তাকায়নি!”
অথচ আরলিন জানতো না দু’মিনিট আগেও তার ভাষায় প্রাণবন্ত মানুষগুলোও রিচার্ড যা করছিল ঠিক তাই করছিলো।

আরলিন গ্রিনবামের সাথে রিচার্ডের প্রথম কথা হয় একটা নাচের পার্টিতে। আরলিনের জনপ্রিয়তা তখন সাংঘাতিক। তার সৌন্দর্যের জন্য এবং তার ব্যক্তিত্বের জন্যও বটে। সবাই তার সাথে নাচতে চাচ্ছিলো। ফলে সবাই অন্য কারো সাথে নাচতে নাচতেই আরলিনের কাছে চলে যাচ্ছিলো। রিচার্ডও ভাবছিল কীভাবে আরলিনের সাথে নাচা যায়।

ড্যান্স পার্টির সুবিধে হলো হাত ধরে নাচা যায়। কিন্তু সমস্যা হলো সঠিক সময়ে পা বাড়ানো। রিচার্ডের এরকম সমস্যা ভয়াবহ। প্রায়ই সে এরকম সমস্যায় পড়ে। আরলিন যখন ফ্লোরের অন্য প্রান্তে একজনের সাথে নাচছে তখন রিচার্ড ভাবছে – ‘এদিকে এলেই তার সাথে নাচবো।’ কিন্তু যখন ঘুরতে ঘুরতে তার কাছে আসে তখন মনে হয় মিউজিকটা তেমন ভালো নয় বা এই মিউজিকের সাথে সে ভাল নাচতে পারে না। অপেক্ষা করতে থাকে নতুন মিউজিকের। যখন মিউজিক পছন্দ হয় তখন দেখা যায় আরলিন তার কাছ থেকে অনেক দূরে। তারপরেও সাহস করে কয়েক স্টেপ এগোনোর পর দেখা যায় সাঁ করে অন্য কেউ ঢুকে পড়ে নাচতে শুরু করেছে আরলিনের হাত ধরে। এখন আবারো অপেক্ষা করতে হয় কিছুক্ষণ। কারণ সেই মুহূর্তে তাদের নাচের ভেতর ঢুকে গিয়ে হাত ধরা অভদ্রতা। ভদ্রতার সময় যখন পেরুবে তখন দেখা যাবে হয় মিউজিক বদলে গেছে বা অন্যপ্রান্তে চলে গেছে আরলিন।

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল রিচার্ড। বোকার মতো হাঁটাহাঁটি করলো, অন্য কারো সাথে নাচার চেষ্টা করলো। কিন্তু তার মন পড়ে আছে আরলিনে। আরলিনের সাথে ছাড়া আর কারো সাথে নাচতে কোন উৎসাহ পেলো না সে। মরিয়া হয়ে একটা চেষ্টা করলো সে। এক বন্ধুর কানে কানে বললো তার ইচ্ছের কথা। বন্ধুটি বেশ জোরে চিৎকার করে ঘোষণা করল, “বন্ধুগণ শোন, ফাইনম্যান আরলিনের সাথে নাচতে চায়।”

একথা শোনার পর আরলিনের সাথে যে নাচছিলো সে নাচতে নাচতেই রিচার্ডের সামনে এসে আরলিনের হাত ছেড়ে দিলো। আর রিচার্ডের বন্ধুটি পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে রিচার্ডকে ড্যান্সফ্লোরে পাঠিয়ে দিল। রিচার্ড আরলিনের হাত ধরে নাচতে শুরু করলো। আরলিনকে প্রথম যে কথাটি সে বললো তা ছিলো একটা প্রশ্ন – “এরকম জনপ্রিয়তা কেমন লাগে তোমার?”

আরলিন উত্তর দেবার আগেই রিচার্ডকে ডিঙিয়ে আরেকজন নিয়ে গেল আরলিনকে।
রিচার্ড ও তার বন্ধুরা সবাই নাচ শিখেছিল। কিন্তু কেউই তা স্বীকার করতে চাইত না। তখন আমেরিকার অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ। সবাই কোন না কোনভাবে উপার্জনের উপায় খুঁজছিল। রিচার্ডের মায়ের এক বান্ধবী একটা নাচের স্কুল খুলেছিলেন বাসার দোতলার একটা ঘরে। ধরতে গেলে ওটাই ছিল ঐ সময় তার উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন। রিচার্ডের মত ছেলেদের জন্য তিনি ঘরের পেছনে একটা গোপন দরজা তৈরি করেছিলেন যেন গোপনে গিয়ে নাচ শেখা যায়। ছেলেদের নাচ শিখতে কেন লজ্জা লাগতো তা রিচার্ড ভেবে পেতো না, কিন্তু তার নিজেরই লজ্জা করতো আরো বেশি।

নাচের স্কুলটি বেশ চলছিল। সবাই যার যার মতো গিয়ে নাচ শিখে আসতো। ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সমস্যা ছিল বেশি। নাচতে গিয়ে দেখা যায় ছেলেরাই সব সময় মেয়েদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। মেয়েরা কখনো তাদের নাচের সঙ্গী নির্বাচন করতে পারতো না। অন্তত তাদের ইচ্ছা হলেও তারা তা প্রকাশ করতে পারতো না। আর ছেলেরা তো সবসময় সুন্দরী মেয়েদের সাথে নাচতে চাইতো। তাই যে মেয়েরা একটু কম সুন্দর তাদের মুখ গোমড়া করে বসে থাকা ছাড়া উপায় থাকতো না।

আবার রিচার্ডের মত যারা বেশি চিন্তা করে তাদের জন্যও ব্যাপারটা সহজ ছিল না। একটা পার্টিতে রিচার্ড দেখলো একটা মেয়ে চুপচাপ বসে আছে। রিচার্ড অনেকক্ষণ ধরে নাচতে চাইছে কিন্তু সুযোগ পাচ্ছে না। মেয়েটিকে দেখে ভাবল যাক এবার একজনকে পাওয়া গেল। কিন্তু ব্যাপারটা অত সহজ নয়। রিচার্ড এগিয়ে গিয়ে নাচার প্রস্তাব দিলো। কিন্তু মেয়েটি বললো, “ধন্যবাদ, এখন আর নাচতে পারব না। আমি খুব টায়ার্ড।”

রিচার্ডের খুব খারাপ লাগলো। নিজেকে সান্ত্বনা দিল – আহা বেচারি হয়তো আসলেই ক্লান্ত। কিন্তু একটু পরে তার নিজের গালে থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করল যখন দেখল সেই ক্লান্ত মেয়েটিই নাচছে তার সামনে অন্য একজনের হাত ধরে। ছেলেটি হয়তো তার বয়ফ্রেন্ড। মেয়েটি হয়তো তার জন্যই অপেক্ষা করছিলো এতক্ষণ। অথবা তার পছন্দ হয়নি রিচার্ডকে। তার পোশাক হয়তো অতটা উজ্জ্বল নয় যতটা মেয়েটার পছন্দ। এরকম অনেক কিছুই ভাবা যায়। রিচার্ড অবাক হয় দেখে যে কত অবৈজ্ঞানিক সহজ ব্যাপার চোখের সামনে কীভাবে জটিল হয়ে যায়।

একদিন এরকম একটা নাচের পার্টিতে রিচার্ড নিমন্ত্রণ করলো আরলিনকে। আরলিনের সাথে ওটাই তার আমার প্রথম বাইরে যাওয়া। রিচার্ডের প্রিয় বন্ধুরাও ছিলো ওই পার্টিতে। পার্টিটা হচ্ছিলো রিচার্ডের মায়ের বন্ধুর নাচের স্কুলে। রিচার্ডের মা-ই রিচার্ডের সব বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করেছেন যেন তাঁর বান্ধবীর নাচের স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ে। এই বন্ধুরা রিচার্ডের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারমধ্যে কয়েকজন কবি টাইপের, আবার কয়েকজন বৈজ্ঞানিক টাইপের। তারা যখন রিচার্ডকে আরলিনের সাথে দেখলো হৈ হৈ করে কাছে চলে এলো।
কয়েকজন বলতে লাগলো, “ফাইনম্যান, আমরা জানি আরলিন আজ তোমার। সুতরাং আমরা কেউ আজ আরলিনের দিকে হাত বাড়াবো না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।”

রিচার্ড তাদের কথা পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও মোটামুটি আশ্বস্ত হয়েছিল। কিন্তু একটু পরেই দেখা গেলো তারাও বারবার রিচার্ড আর আরলিনের নাচের মধ্যে ঢুকে পড়ছে আর আরলিন তার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। যে বন্ধুটি আশ্বাস বাক্য উচ্চারণ করেছিলো তার ভূমিকা আরো বেশি এক্ষেত্রে। মনের দুঃখে রিচার্ডের গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু লজ্জায় তাও করতে পারছিল না।

মেয়েদের ব্যাপারে রিচার্ড তখনো খুব লাজুক। তাছাড়া কিছুটা ভয়ে ভয়েও থাকত কারণ তার বন্ধুরা সবাই ছিল তার চেয়ে শক্তিশালী। সবাই বেসবল খেলত, নানারকম শরীরচর্চা করতো। আর রিচার্ড খেলাধূলার ধারে কাছেও যেত না। কোথাও খেলা হলে রিচার্ডের চিন্তা হতো কীভাবে সেখান থেকে পালানো যায়। তার চিন্তাগুলোও ছিল অদ্ভুত – “যদি একটা বল হঠাৎ আমার সামনে এসে পড়ে। আমাকেই যদি বলটা নিয়ে থ্রো করতে হয়। আমার ছুঁড়ে দেয়া বলটা যদি জায়গামতো না যায় সবাই হাসবে। এর চেয়ে লজ্জার কাজ আর কী হতে পারে?”

কিছুদিন পরে আরলিন নিমন্ত্রণ করলো রিচার্ডকে তাদের বাড়িতে। বিরাট পার্টি হচ্ছে সেখানে। সবাই এসেছে। কারণ আরলিন তখন রিচার্ডদের পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে। সবাই পছন্দ করে তাকে। সুতরাং তার পার্টিতে সবাই আসবে এটাই স্বাভাবিক। রিচার্ড অনেকটা হীনমন্যতায় ভুগতে ভুগতে জগতের অসারতা চিন্তা করতে করতে একটা সোফায় বসেছিল। একটু পরে আরলিন এসে বসলো তার সোফার হাতলে। সেই মুহূর্তে আরলিনকে দেখে রিচার্ডের মনে হলো পৃথিবীটা এত্তো সুন্দর কেন। যে রিচার্ড কখনো কবি টাইপের ছিল না তারও মনে হলো একটা কবিতা লিখলে কেমন হয় আরলিনকে নিয়ে? রিচার্ড আরলিনের প্রেমে পড়ে গেল।

সেসময় ইহুদি ছেলেমেয়েদের জন্য বেশ বড় একটা ইয়থ সেন্টার ছিলো সেখানে। বেশ বড় ক্লাব। অনেক কার্যকলাপ, অনেকগুলো গ্রুপে কাজ চলতো। একদল ছিলো লেখক গ্রুপ – তারা গল্প লিখে নিজেদের মধ্যে পড়ে শোনাতো। আরেক দল ছিলো নাটকের গ্রুপ – নাটক লিখে তা মঞ্চস্থ করতো। একটা বিজ্ঞান গ্রুপ ছিল আর ছিলো আর্টস গ্রুপ। বিজ্ঞান গ্রুপটা ছাড়া আর কোন গ্রুপের প্রতি বিন্দুমাত্রও আগ্রহ ছিল না রিচার্ডের। কিন্তু আরলিন ছিল আর্টস গ্রুপে। তাই রিচার্ডও আর্টস গ্রুপে যোগ দিল।

আর্টস গ্রুপে যোগ দিয়ে টিকে থাকার জন্য রীতিমত যুদ্ধ করতে হল রিচার্ডের। ছবি আঁকা, মূর্তি তৈরি করা তার কখনো আয়ত্ত্বে ছিল না। আগ্রহও ছিল না কখনো। শুধুমাত্র আরলিনের গ্রুপে থাকার জন্যই তার এ অবস্থা। কিন্তু আরলিনের ব্যাপারে তেমন সুবিধা করতে পারলো না রিচার্ড। আরলিনের একজন বয়ফ্রেন্ড ছিল। নাম জেরোম। একই আর্টস গ্রুপে। সুতরাং রিচার্ডের কোন চান্সই রইলো না। তবুও রিচার্ড আরলিনের পেছনে ছায়ার মত ঘুরতে লাগলো।
ইয়থ সেন্টারের বিভিন্ন পদের জন্য নির্বাচন হয় প্রতিবছর। সেবছর রিচার্ডের অনুপস্থিতিতে কে যেন তার নাম প্রস্তাব করলো প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের জন্য। বড়রা রিচার্ডের নাম শুনে রীতিমত নার্ভাস হয়ে পড়লেন। কারণ ইতোমধ্যেই ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত ঘটনাগুলোর সত্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে নাস্তিক হিসেবে যথেষ্ট অখ্যাতি অর্জন করে ফেলেছে রিচার্ড। ইহুদিদের এই ক্লাবটার উদ্দেশ্যই ছিল ছেলেমেয়েদের মধ্যে ধর্মের প্রতি টান তৈরি করা। সেই ক্লাবে রিচার্ডের মত নাস্তিককে সভাপতির পদে নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন দেয়াটা বড়দের ভীষণ বিব্রত করে তুললো। তারা রিচার্ডের বিরুদ্ধে একজোট হলেন। নির্বাচনে হেরে গেল রিচার্ড। কিছুদিন পরে যখন ক্লাবটাই বন্ধ হয়ে গেল হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো রিচার্ড। সে নির্বাচিত হবার পরে ক্লাব বন্ধ হলে সব দোষ পড়তো তার ওপর।

কিন্তু আরলিনের সাথে শিল্পকর্মে যোগ দেয়া বন্ধ হয়ে যাওয়াতে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল রিচার্ডের। চোখের দেখা দেখার সুযোগ যা ছিল তাও গেল। প্রচন্ড হতাশার মাঝেও একদিন আরলিনের সাথে দেখা হল রিচার্ডের। কথা প্রসঙ্গে আরলিন জানালো জেরোমের সাথে তার সম্পর্ক শেষ। জেরোম আর তার বয়ফ্রেন্ড নয়। রিচার্ডের জন্য এর চেয়ে আনন্দের সংবাদ আর হতে পারে না। তার পৃথিবী হঠাৎ যেন হাজারটা চাঁদের আলোয় আলোকিত হয়ে গেল। আবারো আশা জাগছে প্রাণে। আরলিন রিচার্ডকে তাদের বাসায় যেতে বললো।

পর্ব-২