এই একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান অগ্রগতির সুফল কাজে লাগিয়ে মানুষ প্রকৃতির অসংখ্য অজানা রহস্যের সমাধান করে ফেলেছে। গবেষণাগারে উন্নত জাতের কৃত্রিম প্রজাতির শস্যবীজ উৎপাদন করে মানুষ এখন আগের তুলনায় চার-পাঁচগুণ বেশি খাদ্যোৎপাদন করতে সক্ষম হচ্ছে। কৃত্রিম সার উৎপাদন করে জমির উর্বরাশক্তি বাড়াবার সুযোগ পাচ্ছে। পারমাণবিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বিপুল পরিমাণ ব্যবহারযোগ্য শক্তি এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ আবিষ্কার করে অনেক প্রাণঘাতী রোগ সমূলে বিনাশ করতে সক্ষম হয়েছে আজকের মানুষ। আধুনিক সভ্যতার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ – ক্যান্সার রোগের চিকিৎসাতেও ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। আজ ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, নিউক্লিয়ার মেডিসিন। রোগ নির্ণয়ে ব্যবহৃত হচ্ছে পজিট্রন এমিশান টমোগ্রাফি (PET), সিঙ্গেল ফোটন এমিশান কম্পিউটেড টমোগ্রাফির (SPECT) মত অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। মানুষ আজ মানব-মস্তিষ্কের স্ক্যান করে স্কিৎজোফ্রেনিয়া, পার্কিনসন’স ডিজিজ, অটিজমসহ আরো অনেক জটিল রোগের কারণ শনাক্ত করার গবেষণায় অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এর সবকিছুই সম্ভব হচ্ছে নিউক্লিয়ার আইসোটোপের ব্যাপক ব্যবহারের মাধ্যমে। মানুষ আজ নিউক্লিয়ার প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে তৈরি করছে কৃত্রিম-তেজষ্ক্রিয়তা, প্রয়োজনীয় রেডিও-আইসোটোপ। এই কৃত্রিম তেজষ্ক্রিয়তা আবিষ্কৃত হয়েছে ১৯৩৪ সালে ‘তেজষ্ক্রিয়তা-জগতের রাজকুমারী’ আইরিন কুরি ও তাঁর স্বামী ফ্রেডেরিক জুলিওর হাতে। পরমাণুর নিউক্লিয়াসের একটি প্রধান উপাদান ‘নিউট্রন’ আবিষ্কারের পথ দেখিয়েছেন আইরিন ও ফ্রেডেরিক। নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় বিরাট ভূমিকা রেখেছে জুলিও-কুরির পরীক্ষালব্ধ ফল।

১৯৩৫ সালের ১০ ডিসেম্বর সুইডেনের স্টকহোমে নোবেল পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে রসায়নে নোবেল বিজয়ী আইরিন কুরি ও ফ্রেডেরিক জুলিও’র আবিষ্কার সম্পর্কে বলা হলো – “আপনাদের গবেষণার ফলাফল মৌলিক বিজ্ঞানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু তাই নয়, শারীরতত্ত্ববিদ, চিকিৎসক এবং যাঁরা রোগে ভুগছেন সবাই প্রভূত উপকৃত হবেন আপনাদের এই আবিষ্কারের ফলে।” স্বভাব-লাজুক আটত্রিশ বছর বয়স্কা আইরিন কুরির হাতে নোবেল পুরষ্কার তুলে দেবার সময় সুইডেনের রাজা পঞ্চম গুস্তাভ বললেন, “চব্বিশ বছর আগে ঠিক এখানেই আমি আপনার মায়ের হাতে তুলে দিয়েছিলাম ১৯১১ সালের রসায়নের নোবেল পুরষ্কার। আপনি ইতিহাস তৈরি করলেন মাদাম জুলিও-কুরি।”

সত্যিই ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন আইরিন কুরি। তাঁর মনে পড়ছে চব্বিশ বছর আগে মায়ের সাথে যখন এসেছিলেন এই নোবেল অনুষ্ঠানে তখন তিনি চৌদ্দ বছরের কিশোরী। সেদিন তিনি ভাবতেও পারেননি যে আবার কখনো এখানে আসার সুযোগ পাবেন। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও চিকিৎসাবিজ্ঞান – এই তিন বিষয় মিলিয়ে বিজ্ঞানে প্রথম নারী নোবেল বিজয়ী ছিলেন তাঁর মা মেরি কুরি ১৯০৩ সালে। আট বছর পর ১৯১১ সালে দ্বিতীয় বার বিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন যে নারী – তিনিও একই ব্যক্তি – মেরি কুরি। তারপর চব্বিশ বছর কেটে গেছে – আর কোন নারী বিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পাননি। এবার ১৯৩৫ সালে নিজের মায়ের নামের পাশেই নামাঙ্কিত হলো মেয়ে আইরিন কুরির। আইরিন কুরিই হলেন পৃথিবীতে একমাত্র নারী যাঁর মা-বাবা, স্বামী এবং নিজেও নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী।

আইরিনের পাশে দাঁড়িয়ে উৎসাহ, উত্তেজনা আর খুশিতে টগবগ করছেন তাঁর স্বামী পঁয়ত্রিশ বছর বয়স্ক ফ্রেডেরিক জুলিও। স্ত্রীর প্রতি তাঁর ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। ফ্রেডেরিক জানেন আইরিন পাশে না থাকলে তাঁর একার পক্ষে কখনো এতদূর আসা সম্ভব হতো না। আইরিন কর্মক্ষেত্রে আক্ষরিক অর্থেই ফ্রেডেরিকের বস্‌। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতার স্বীকৃতি স্বরূপ ফ্রেডেরিক তাঁর পদবীর সাথে স্ত্রীর পদবীও যোগ করে ‘জুলিও-কুরি’হয়ে গেছেন। ইউরোপের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এরকম ঘটনা সত্যিই বিরল। ধীর-স্থির গম্ভীর আইরিনের সাথে হাসি-খুশি চঞ্চল ফ্রেডেরিকের বাহ্যিক আচরণে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। তবে তাঁদের মিলটা কোথায়? কোথায় তাদের ভালোবাসার রসায়ন?

আইরিন

পদার্থবিজ্ঞানের জগতে বেশ কয়েকটি যুগান্তকারী আবিষ্কারের সমসাময়িক সময়ে আইরিনের জন্ম। উইলহেল্‌ম রন্টগেনের এক্স-রে আবিষ্কারের দু’বছর পর, হেনরি বেকোয়ারেলের তেজষ্ক্রিয়তা আবিষ্কারের পরের বছর ১৮৯৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পিয়ের ও মেরি কুরির প্রথম সন্তান আইরিন কুরির জন্ম। নির্ধারিত সময়ের প্রায় চার সপ্তাহ আগে জন্ম হয় আইরিনের। মেরি কুরি তখন প্যারিসের মেয়েদের স্কুলে ফিজিক্সের শিক্ষক এবং পিয়ের কুরি ইকোল মিউনিসিপেল দ্য ফিজিক অ্যাট কিমিয়ে ইন্ডাস্ট্রিয়েল্‌স (ইপিসিআই) এর ফিজিক্স ল্যাবের প্রধান। আইরিনের জন্মের দু’সপ্তাহ পর তার দিদিমা (পিয়েরের মা) মারা যান। কিছুদিন পর পিয়ের তাঁর বাবাকে নিজেদের কাছে নিয়ে আসেন। ডাক্তার ইউজিন কুরি বুকে তুলে নেন নাতনি আইরিনকে। দাদুর সাথে গভীর আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে আইরিনের।

গবেষণা ও পড়ানোর কাজে খুব ব্যস্ত আইরিনের মা-বাবা। পিয়ের গবেষণা করছেন কৃস্টালের চৌম্বক-ধর্ম নিয়ে। মেরি তাঁর ডক্টরেট ডিগ্রির গবেষণার জন্য কাজ শুরু করেছেন সদ্য আবিষ্কৃত তেজষ্ক্রিয়তার ধর্মের ওপর। দিনরাত পরিশ্রম করে নতুন ধরনের তেজষ্ক্রিয় পদার্থের সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছেন মেরি। আইরিনের জন্মের পর সামান্য কয়েক সপ্তাহ বিশ্রামের পর দ্রুত কাজে ফিরে গেছেন তিনি। কাজের অগ্রগতির পাশাপাশি আইরিনের অগ্রগতির কথাও লিখে রাখেন আলাদা আলাদা নোটবুকে। ১৮৯৮ সালের জুন মাসে পাওয়া গেলো নতুন তেজষ্ক্রিয় মৌল – নিজের জন্মভূমির নামানুসারে মেরি যার নাম রেখেছেন পোলোনিয়াম। পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে পাওয়া গেলো আরো শক্তিশালী নতুন মৌল রেডিয়াম। আইরিনের মতো রেডিয়াম-পোলোনিয়ামও যেন মেরির সন্তান। আইরিনের মা-বাবা আইরিনের চেয়েও বেশি সময় দিতে লাগলেন রেডিয়ামকে।

দাদুর কোলে-পিঠেই বেড়ে উঠছে আইরিন। শুধুমাত্র ছুটির দিনে কিছুটা সময় মা-বাবাকে কাছে পায়। তার বয়স যখন পাঁচ-ছয় বছর মা-বাবা আরো ব্যস্ত হয়ে যান। দেখা যায় সন্ধ্যাবেলা বাসায় ফিরে ডিনারের পর আবার গবেষণায় ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন। আইরিন তখন কান্নাকাটি শুরু করে। মা তাকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করেন। অভিমান হয় ছোট্ট আইরিনের। মা-বাবা কেন তার কাছ থেকে দূরে থাকে সব সময়? অনেক সময় ঘুমের ভান করে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে থাকে। মা তখন তাকে দাদুর কোলে দিয়ে বাবার সাথে বেরিয়ে যান কাজে। আইরিন চোখ খুলে দেখে দাদুর মুখ।

দাদু আইরিনকে বোঝান – মা-বাবার গবেষণার কাজ কত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা এমন কিছু আবিষ্কার করেছেন যা দিয়ে পৃথিবীর কোটি মানুষের উপকার হবে। নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা না করে মানুষের উপকারের চেষ্টা করার নামই যে মানব-ধর্ম তা আইরিনের মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দেন তার দাদু। মা-বাবার কথা শুনতে শুনতে ‘ল্যাবরেটরি’, ‘রেডিওএক্টিভিটি’, ‘রেডিয়াম’, ‘পোলোনিয়াম’ ইত্যাদি শব্দের সাথে খুবই পরিচিত হয়ে যায় ছোট্ট আইরিন।

১৯০৩ সালে আইরিনের বয়স যখন সাড়ে পাঁচ – একদিন ঘুম থেকে জেগে দেখে মা-বাবা নেই। আইরিন ভাবলো তারা ‘ল্যাবরেটরি’তে গেছে। কিন্তু সন্ধ্যাবেলায়ও তারা না ফেরাতে দাদুকে জিজ্ঞেস করে আইরিন – “মি আর পি কোথায় গেছে গ্র্যানপি?” মাকে ‘মি’ আর বাবাকে ‘পি’ বলে ডাকে আইরিন।
“মি-পি লন্ডনে গেছে।”
“কেন?”
“রয়েল ইনস্টিটিউটে বক্তৃতা দিতে।”
“কেন?”
“তারা রেডিয়াম আবিষ্কার করেছে তো, এই রেডিয়াম সম্পর্কে এখন পি আর মি ছাড়া আর কেউ তেমন কিছু জানে না। তাই সবাই তাদের কাছ থেকে জানতে চাচ্ছে।”
“কেন?”
ক্লান্তিহীনভাবে আইরিনের সীমাহীন ‘কেন?’র উত্তর দিয়ে যান গ্র্যানপি ইউজিন কুরি। আইরিনের কোন প্রশ্নের উত্তরেই তিনি বিরক্ত হন না। আইরিন এই বয়সেই অনেক ধীর-স্থির, বুদ্ধিমতী।

মা-বাবা ও দাদুর সাথে আইরিন

দু’দিন পর মা-বাবা ফিরে এসে আইরিনের গলায় পরিয়ে দিলেন একটা সোনার মেডেল।
“এটা কী পি?”
“এটা হলো ড্যাভি গোল্ড মেডেল।”
“ড্যাভি কী?”
“ড্যাভি কী নয়, কে। স্যার হ্যামফ্রি ড্যাভি ছিলেন ইংল্যান্ডের বিখ্যাত রসায়নবিদ। তাঁর নামে রয়েল সোসাইটি এই মেডেল দেয় প্রতি বছর। এ বছর তোমার মি আর পি-কে দিয়েছে এই মেডেল। দেখো তো মেডেলে কার নাম লেখা আছে।”
আইরিন ততদিনে বানান করে পড়তে শিখে গেছে। ফরাসির পাশাপাশি ইংরেজিও শিখছে। দেখলো মেডেলের গায়ে লেখা আছে ‘পিয়ের কুরি এন্ড মেরি কুরি’ – তার পি আর মি’র নাম।

১৯০৩ সালেই আইরিন দেখলো মা-বাবা কত বিখ্যাত হয়ে গেছেন। জুন মাসে মা সরবোন ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি পেলেন। দাদু যখন বললেন – “মি এখন ডক্টর মেরি কুরি” – আইরিন জিজ্ঞেস করে – “তোমার মতো মিও কি ডাক্তার হয়েছে?
“আমার মতো না। মি হলো ডক্টরেট। সারা ইউরোপে তোমার মি-ই হলো প্রথম মহিলা ডক্টরেট।”

কয়েক মাস পরেই মেরি ও পিয়ের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেলেন। আইরিন জানলো যে তার মি-ই সারা পৃথিবীতে প্রথম মহিলা বিজ্ঞানী যিনি নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। সংবাদপত্রে পি’র ছবি বের হয়েছে। সাংবাদিকরা বাড়িতেও আসতে শুরু করেছে।

একদিন সকালে মা-বাবা বেরিয়ে গেছেন। দাদু গেছেন দোকানে। কাজের লোক রান্না করছে। আর আইরিন ডিডির সাথে খেলছে। ডিডি হলো তার পোষা সাদা-কালো বেড়াল। খেলতে খেলতে আইরিন দেখলো দু’জন লোক ঘরে ঢুকে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে আর সমানে ছবি তুলছে। মা-বাবার পড়ার টেবিল, বুক শেলফের বই, টেবিলে রাখা ফুলের তোড়া সবকিছুই খুটিয়ে দেখছে তারা। আইরিন কিছু না বলে চুপচাপ দেখছে তারা কী করে। এবার তারা আইরিনকে প্রশ্ন করা শুরু করলো – “তোমার মা-বাবা কোথায়?”
“ল্যাবরেটরিতে”
“তুমি কি একা একা বাসায় থাকো?”
“না”
“আর কে থাকে?”
“গ্র্যানপি”
“তোমার মা কি রান্না করেন? কখন ঘুমাতে যান তারা? কখন ঘুম থেকে উঠেন? কখন অফিসে যান?”
এরকম প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছে লোকদুটো। ছয় বছরের শিশু আইরিনও বুঝতে পারছে এসব প্রশ্নের সাথে রেডিয়ামের কোন সম্পর্ক নেই, তাই এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার কোন দরকার নেই। সে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে খাবার খেতে শুরু করলো। লোকদুটো ডাইনিং টেবিলে গিয়ে আইরিনের ছবি তুলে চলে গেলো।

পরদিন সংবাদপত্রে আইরিনের ছবিসহ প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো ‘মা নোবেল পায়, শিশু একা একা খাবার খায়’। প্রতিবেদনে সংসার ও সন্তানের প্রতি অবহেলা করছেন বলে মেরির সমালোচনা করা হয়।

বিনা অনুমতিতে শিশু আইরিনের ছবি তুলে তা সংবাদপত্রে ছাপানোয় ভীষণ বিরক্ত পিয়ের ও মেরি কুরি। পিয়ের সংবাদপত্রের সম্পাদককে চিঠি লিখে জানান তাঁর ক্ষোভের কথা।

সাংবাদিকরা মা-বাবার সময় নষ্ট করেছে দেখেছে আইরিন। মা-বাবা বাসায় আসার সাথে সাথে তারাও এসে হাজির হয়। আগে মা-বাবাকে যতটুকু কাছে পেতো এখন তাও পায় না আইরিন। সাংবাদিকদের ওপর তার তাই ভীষণ রাগ। সেই ছোটবেলায় প্রেস-মিডিয়ার প্রতি যে বিরক্তি এসেছে আইরিনের – সারাজীবনেও সে বিরক্তি যায়নি।

একদিন সন্ধ্যায় আইরিন দেখলো মা-বাবা কাজ থেকে ফিরে জামা-কাপড় বদলে আবার বেরোচ্ছেন। মা-কে আগে কখনো এরকম সুন্দর ইভনিং-গাউন পরতে দেখেনি আইরিন। কী যে সুন্দর লাগছে মাকে – একেবারে ছবির বইয়ের রানির মত লাগছে। বেরোনোর সময় আইরিনকে চুমু খেয়ে মা বললেন, “লক্ষ্মী হয়ে থেকো সোনা। গ্র্যানপির সাথে খেয়ে ঘুমিয়ে যেয়ো। আমাদের আসতে দেরি হতে পারে।”
“কেন যাচ্ছো মি? এখন তুমি আমার সাথে একটুও থাকো না।”
“কী করবো সোনা, প্রেসিডেন্ট নিমন্ত্রণ করেছেন আমাদের। কীভাবে না বলি?”
“প্রেসিডেন্ট তোমাকে আমার কাছ থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে।”

পিয়ের আইরিনের মাথায় হাত রেখে আদর করছিলেন। বললেন, “মেয়ে ঠিকই বলছে মেরি। সবাই মিলে আমাদের সবটুকু সময় ছিনিয়ে নিচ্ছে। নোবেল পুরষ্কার পাবার পর গবেষণা তো দূরের কথা, মেয়েটাকেও ঠিকমত সময় দিতে পারছি না।”

আইরিনকে তার দাদুর কাছে রেখে মা-বাবা চলে গেলেন প্রেসিডেন্টের বাসভবনে তাঁদের সম্মানে দেয়া ডিনারপার্টিতে। আইরিন দাদুকে জিজ্ঞেস করে, “গ্র্যানপি, যারা ছিনিয়ে নেয় তারা কি ডাকাত?”
“প্রচলিত অর্থে ছিনতাইকারি বা ডাকাত বলা যায়। কেন জিজ্ঞেস করছো?”
“যারা মি-পির সময় ছিনিয়ে নিচ্ছে তারাও ডাকাত?”
“হ্যাঁ, তা তুমি বলতে পারো, কিন্তু আইরিন ডাকাতরা তো শুধু জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয়। সময় কিন্তু জিনিস নয়।”

তারপর দাদু নাতনিকে সময় সম্পর্কে ধারণা দিতে শুরু করলেন। আইরিন ঘড়িতে সময় দেখতে চিনে গেলো। সময় নষ্ট করা যে খারাপ তাও জেনে গেলো।
কিছুদিন পর মি-পির সাথে ছুটি বেড়াতে গেলো আইরিন। সেখানে সমুদ্রের পানিতে সাঁতার কাটলো আইরিন। তিন বছর বয়স হবার আগেই সাঁতার কাটতে শিখে গেছে আইরিন। পাঁচ বছর হবার আগেই সাইকেল চালাতে পারে। মি-পি গ্র্যানপি সবাই বাগান করতে পছন্দ করে। আইরিনও সেখানে হাত লাগায়।

১৯০৪ সালের ডিসেম্বরে আইরিনের ছোটবোন ইভের জন্ম হয়। আইরিনের একজন খেলার সাথি হলো। পাশের বাসার প্রফেসর জাঁ পেরির ছেলে-মেয়ে আলিন ও ফ্রান্সিস আইরিনের ভালো বন্ধু। আইরিন তাদের সাথেও খেলে। কিন্তু অপরিচিত কারো সাথে আইরিন কথাই বলতে চায় না। যতই বড় হচ্ছে তার এই সমস্যা বাড়ছে। মেরি কুরি মেয়ের এই সমস্যা কাটানোর জন্য বাড়িতে অনেক বন্ধুবান্ধব ডেকে পার্টি দিয়েছেন – যেন তাদের ছেলে-মেয়েদের সাথে আইরিনের বন্ধুত্ব হয়। কিন্তু আইরিন তাদের কারো সাথেই কোন কথা বলে না। বাইরের কারো সামনে সে হাসেও না, গম্ভীর হয়ে থাকে।

১৯০৬ সালের এপ্রিলে আইরিনের বয়স যখন সাত – আইরিনের মনে আছে খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো সেদিন ও তার আগের দিন। তারা ছুটি কাটিয়ে মাত্র ফিরেছে প্যারিসের বাড়িতে। সেদিন বাবা অফিসে যাওয়ার সময় আইরিন দোতলায় ছিল। মা তখন তাকে রেডি করাচ্ছিলেন স্কুলে নিয়ে যাবার জন্য। স্কুল মানে আইরিনের স্কুল নয়, মায়ের স্কুল অব ফিজিক্স, মা যেখানে পড়ান। ইভ হবার পর মা-বাবা বেরিয়ে গেলে গভর্নেস ইভের দেখাশোনা করেন। দাদুও বুড়ো হচ্ছেন। তাই মা আইরিনকে সাথে নিয়ে যান। সেদিনও আইরিন মায়ের সাথে থেকেছে। মায়ের ছাত্রীদের সাথে চুপচাপ বসে মায়ের পড়ানো দেখেছে। মায়ের ছাত্রী ইউজেনির সাথে খুব বন্ধুত্ব আইরিনের। ইউজেনি আইরিনের সাথে অনেক গল্পও করেছে। মা সেদিন তাড়াতাড়ি পড়ানো শেষ করে দ্রুত বাসায় ফিরেছেন। আসার সময় বলেছেন রাতে অনেক প্রফেসর আসবেন বাসায় ডিনার করতে।

কিন্তু বাসায় ফিরে দেখে অনেক মানুষ তাদের বাসায়। আইরিন ভাবলো এই প্রফেসরদের কথাই কি মি বলেছিলেন? কিন্তু মা ইভ আর তাকে হেনরিয়েট আন্টিদের বাসায় পাঠিয়ে দেন। আইরিন বুঝতে পারে না কী হয়েছে। সে আলিন আর ফ্রান্সিসের সাথে খেলা করেছে।

হেনরিয়েট আন্টির সাথে মায়ের কথাবার্তা শুনে আইরিন বুঝতে পারছে তার বাবার কিছু হয়েছে। ষোল মাস বয়সী ছোট্ট ইভ কিছু বোঝে না, কিন্তু আইরিন বুঝতে পারে। সে মায়ের কাছে যাবার জন্য কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। মা আইরিনকে বোঝান যে বাবার মাথায় আঘাত লেগেছে, বাড়ি ফিরতে কয়েক দিন দেরি হবে। পরের দিনই আইরিন বুঝতে পারে বাবা আর কখনো বাড়ি ফিরবেন না, বাবা মারা গেছেন।

সাড়ে আট বছর বয়সেই বাবাকে হারিয়ে আরো গম্ভীর হয়ে গেলো আইরিন। দাদু যথাসম্ভব শোক সামলে নাতনিদের দেখাশোনা করতে লাগলেন আগের মতোই। মা প্যারিসের বাসা বদলে সবাইকে নিয়ে চলে গেলেন স্‌সোতে। সেখানে তাদের নতুন বাসায় বেশ বড় একটা বাগান আছে। মা আইরিনকে বাগানের একটা অংশ দিয়ে দিলেন ইচ্ছেমত বাগান করার জন্য। সাত বছরের আইরিন নিজের হাতে বাগান করা শুরু করে – তাকে সাহায্য করেন দাদু।

দাদুর শরীর ক্রমশ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বিছানা থেকে উঠতে পারেন না। বারো বছরের কিশোরী আইরিন যখনই সময় পাচ্ছে দাদুর সেবা করার চেষ্টা করছে।
১৯১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দাদু মারা যান। আইরিনের পৃথিবীটা শোকে স্তব্ধ হয়ে যায়। বাবার মৃত্যুর পর দাদু ছিল তার বন্ধু, শিক্ষক আর পথপ্রদর্শক। দাদুর কাছ থেকে যে ভালোবাসা, দেশপ্রেম, মানবতার শিক্ষা আইরিন পেয়েছে তার তুলনা নেই। দাদুকে হারিয়ে আইরিনের হঠাৎ ভয় করতে শুরু করলো – মাকেও যদি কোনদিন এমনি ভাবে হারাতে হয়! না, সে তার মা ও ছোট বোনকে দেখে রাখবে।

দাদুর মৃত্যুর পর বাসাটা পুরুষ-শূন্য হয়ে গেল। মেরি দুটো কন্যাকে মানুষ করার জন্য যা যা লাগে সব ব্যবস্থা করলেন। মেয়েদের নিজের মাতৃভাষা পোলিশ শেখানোর উদ্দেশ্যে বাসায় পোলিশ গভর্নেস রাখলেন। ইভ ও আইরিন ফরাসির পাশাপাশি পোলিশ ভাষাতেও দক্ষ হয়ে উঠছে। মেয়েদের শারীরিক স্বাস্থ্যের প্রতি কড়া নজর মেরির। তিনি বিশ্বাস করেন ছেলেমেয়েদের শরীর সুগঠিত হলে কোন রোগজীবাণু তাদের আক্রমণ করতে পারবে না, মানসিক বিকাশও অনেক ভালোভাবে হবে। মেয়েদেরকে সাইকেল কিনে দিয়েছেন – তারা ইচ্ছেমতো সাইকেলে চেপে ঘুরে বেড়ায় উন্মুক্ত প্রান্তরে। সাঁতার কাটা, ঘোড়ায় চড়া, নৌকা চালানো, স্কেটিং, স্কিইং, জিমনেস্টিক্‌স সবকিছু শিখিয়েছেন মেয়েদের। আইরিন দেখেছে – যে সাইকেলে চড়া তার মায়ের এত প্রিয় ছিল, স্বামীর মৃত্যুর পর একটা দিনের জন্যেও আর সাইকেলে চড়েননি তার মা।

মায়ের সাথে আইরিন ও ইভ

সারা বছর প্রচন্ড পরিশ্রমের পর গ্রীষ্মকালে তারা ছুটি কাটাতে যেতো কোন পাহাড়ি অঞ্চলে বা সৈকত শহরে। ইভ আর আইরিন – দু’বোন আচরণগত দিক থেকে সম্পূর্ণ দু’রকম। ইভ আর আইরিন দুজনই লম্বা, স্লিম, সুন্দর। আইরিনের চুল কিছুটা ধূসর সোনালী, ইভের চুল কুচকুচে কালো। দুজনেরই পরিষ্কার দৃষ্টি – কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা আলাদা। আইরিন তার বাবার মত ধীরস্থির গম্ভীর। কিন্তু ইভ চঞ্চল হাসিখুশি। আইরিন অপরিচিত কারো সাথে কথা বলে না। আর ইভ অপরিচিতের সাথে পরিচিত হতে মোটেও সময় নেয় না। কারো সাথে দেখা হলে – হাই হ্যালো ইত্যাদি বলার অভ্যাস নেই আইরিনের। এমনকি বিদায় নেবার সময় ‘বাই’ও বলে না আইরিন।

মেরি এসব সামাজিক সহবতকে খুব একটা প্রয়োজনীয় মনে করেন না। তিনি জানেন মানুষ নিজের যোগ্যতায় বড় হতে পারলে এসব সামাজিক সহবতে কিছুই যায় আসে না। তাই তিনি আইরিনকে এসব শেখানোর দরকার আছে বলে মনে করেননি।

আইরিন খেলাধূলায় খুবই দক্ষ। ইভ চমৎকার পিয়ানো বাজায়। আইরিনের ভাবনা-চিন্তার ধরন সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক, ইভের ভাবনাচিন্তা শৈল্পিক। পোশাকের ব্যাপারে ইভ ফ্যাশন-সচেতন, আর আইরিন ফ্যাশনের ধার ধারে না। তার কাছে পোশাক যথাযথ কাজের উপযোগী আরামদায়ক হলেই হলো।

ফ্রান্সের স্কুলের গতানুগতিক শিক্ষাপদ্ধতির ওপর কোন আস্থা ছিল না মেরি কুরির। তিনি দেখছেন ফ্রান্সের স্কুলের শিক্ষার্থীরা দিন-রাত গাধার মত পরিশ্রম করছে, মুখস্থ করছে, পরীক্ষা দিচ্ছে – কিন্তু শিখছে না কিছুই। তিনি এই সিস্টেমের অবসান করতে না পারলেও নিজের মেয়েদের এই শিক্ষার নামে ‘কলুর বলদ’ বানাবার বিপক্ষে। তাঁর কাছের বন্ধু ও সহকর্মীদের নিয়ে তিনি একটা অপ্রাতিষ্ঠানিক কো-অপারেটিভ স্কুল-ব্যবস্থার চালু করলেন।

ছয় জন প্রফেসরের দশজন ছেলেমেয়েকে নিয়ে শুরু হলো তাঁদের প্রচেষ্টা। প্রতি সপ্তাহে একেক জন প্রফেসর একেক বিষয়ে ক্লাস নেন। পদার্থবিজ্ঞানী জাঁ পেরি এবং পল লাঁজেভি পড়াতেন ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি ও গণিত। মেরি কুরি পড়াতেন এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্স। সাহিত্য, শিল্পকলা, সাধারণ বিজ্ঞান, ইংরেজি, জার্মান ইত্যাদি পড়ানোর জন্য সেসব বিষয়ের বিশেষজ্ঞকে নিয়ে আসা হতো। একেক সপ্তাহে একেক প্রফেসরের বাড়িতে ক্লাস বসতো। দশজন ছেলেমেয়ের প্রত্যেকে প্রত্যেকের বন্ধু হয়ে যায়। আইরিনও খুব সহজ ছিল তার এসব বন্ধুদের সাথে। এই দশজনের বাইরে আইরিনের সারাজীবনে আর কোন ফ্রেন্ডসার্কেল গড়ে ওঠেনি।

আড়াই বছর চলার পর কো-অপারেটিভ স্কুলটি আর চললো না। প্রফেসররা নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। স্কুল উঠে গেলেও মেরি কুরি তাঁর ফিজিক্স স্কুলের একটা রুমে প্রতি বৃহস্পতিবার ছেলে-মেয়েদের সারাদিন পড়াতেন। মেরি বিশ্বাস করেন মৌলিক বিজ্ঞানে ভালো করতে হলে পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত বোঝার কোন বিকল্প নেই।

আইরিন চিন্তায় ধীরস্থির – গভীর মনযোগ দিয়ে চিন্তা করতে হয় তাকে। সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগে তার, তবে নির্ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে। একদিন তার মা গণিতের ক্লাস নিচ্ছেন – আইরিনের মনযোগ কিছুক্ষণের জন্য অন্যদিকে চলে গেলো। এ অবস্থায় চারপাশে কী হচ্ছে সে সম্পর্কে কোন ধারণাই থাকে না তার। এসময় মেরি একটা প্রশ্ন করলেন আইরিনকে। আইরিন তার উত্তর দিতে পারলো না। মেরি আইরিনের খাতা নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। আইরিন দেখলো তার খাতা খোলা জানালা দিয়ে উড়ে চলে গেলো বাইরে। সে চুপচাপ উঠে গিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে খাতাটা নিয়ে ক্লাসে এসে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রশ্নটির সঠিক উত্তর দিলো।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-পদ্ধতিকে অপছন্দ করলেও প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিকে অস্বীকার করার উপায় নেই। উচ্চ মাধ্যমিকের সমতুল্য পরীক্ষা দেয়ার জন্য আইরিনকে একটি প্রাইভেট স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হলো। দু’বছর সেই স্কুলে পড়ার পর উচ্চমাধ্যমিক পাস করে আইরিন।

আইরিনের স্কুলে পড়ার সময়েই প্যারিসের প্রেস-মিডিয়া মেরি কুরির নামে কুৎসা রটানো শুরু করে। ১৯১১ সালে আইরিন যখন সবে চৌদ্দ পেরিয়ে পনেরোয় পা দিয়েছে – একদিন স্কুলে গিয়ে সহপাঠিনীর আনা সংবাদপত্রে মঁসিয়ে লাঁজেভির পাশে মায়ের ছবি এবং কুৎসায় ভরা প্রতিবেদনটি পড়ে হঠাৎ মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে যায় আইরিন। সংবাদপত্র যে এত আজেবাজে কথা ছাপাতে পারে তা ভাবতেও পারেনি আইরিন।

একটু পরে মাদাম পেরি স্কুলে এসে আইরিনকে নিয়ে গাড়িতে উঠলে আইরিন দেখে মা ও ইভ ভয়ে অপমানে লজ্জায় থরথর করে কাঁপছে। তাদের বাড়িতে হামলা করেছে প্যারিসের কিছু গুন্ডাপান্ডা লোক। মানুষের এরকম কদর্য দিকের সাথে পরিচিত হয়ে আরো গম্ভীর হয়ে যায় আইরিন। কিন্তু বুঝতে পারে বাবার মৃত্যুর পর তার মায়ের ব্যক্তিগত জীবন কতটাই কঠিন হয়ে গেছে।

মা যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ব্যস্ত থাকেন তা কিছুটা আন্দাজ করতে পারে আইরিন। কিন্তু মা যে বিশ্বসেরা বিজ্ঞানী তা বুঝতে পারে মায়ের সাথে স্টকহোমে গিয়ে। ১৯১১ সালে দ্বিতীয় বার নোবেল পুরষ্কার পেলেন মাদাম কুরি। প্রথমবার ১৯০৩ সালে যখন বাবার সাথে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন মা – তখন অসুস্থতার কারণে বাবা-মা কেউই স্টকহোমে আসতে পারেননি। এবার রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পাবার পর প্যারিসের প্রেসের শত কুৎসা অপবাদ আক্রমণের পরেও মা একটুও দমে যাননি। মাথা উঁচু করে সুইডেনে এসেছেন নিজের যোগ্যতার স্বীকৃতি – নোবেল পুরষ্কার নিতে।

অডিটোরিয়ামের চোখ ঝলসানো আলোয় সঙ্গীত মূর্ছনায় এবং প্রচন্ড করতালির সাথে রাজা পঞ্চম গুস্তাভের কাছ থেকে মা যখন নোবেল মেডেল নিচ্ছিলেন – গর্বে বুক ভরে গেছে আইরিনের। কিন্তু সেদিন একবারের জন্যও সে ভাবেনি যে চব্বিশ বছর পর তার নিজের জীবনেই সেরকম কোন ঘটনা ঘটবে।

১৯১২ সালে প্যারিসে ফিরে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন মাদাম কুরি। কিডনির ইনফেকশানের জন্য প্রায় এক বছর ধরে চিকিৎসা নিতে হয় তাঁকে। প্রেসের অপপ্রচার থেকে বাঁচার জন্য ছদ্মনামে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে অনেকটা গোপনে চিকিৎসা করাতে হয় তাঁকে। আইরিন ও ইভ তখন পোল্যান্ডে তাদের মাসীর কাছে চলে গিয়েছিলো।

১৯১৩ সালে কিছুটা সুস্থ হয়ে মেয়েদের প্যারিসে নিয়ে আসেন মেরি। সেই সামারে আইরিন ও ইভকে নিয়ে সুইজারল্যান্ডে যান মেরি। সেখানে আইনস্টাইনের সাথে দেখা হয় তাঁদের। আইরিন ও ইভের সৌন্দর্যে মুগ্ধ আইনস্টাইন। ইভের পিয়ানোর সাথে বেহালা বাজালেন আইনস্টাইন। ফ্রান্সে ফিরে রেডিয়াম ইনস্টিটিউট তৈরির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন মাদাম কুরি। প্রশাসক ও ব্যবস্থাপক হিসেবে মায়ের আরেক রূপ দেখতে পেলো আইরিন।

মা নিজের কাজে এতই ব্যস্ত থাকেন যে আইরিন ও ইভ পুরোপুরি স্বনির্ভর হয়ে গেলো। বাসার কাজকর্ম দেখাশোনার জন্য একজন গভর্নেস আছেন – তিনি রান্নাবান্না ও অন্যান্য কাজ করেন। আইরিন ও ইভ দুজনই যে যার নিজের কাজ করে নেয়। দু’বোন দু’রকম, দুজনের ইন্টারেস্টও দু’রকম।

আইরিন তার বাবার মতোই খুব সল্পভাষী, ধীরস্থির এবং গভীর চিন্তাশীল। বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে সবকিছু বিবেচনা করে দেখে আইরিন। কোন ব্যাপারেই সময় নষ্ট করার পক্ষপাতী নয় আইরিন। ফ্যাশনেবল প্যারিসে যেখানে মেয়েরা নিত্যনতুন ড্রেস আর রূপচর্চার পেছনে টাকা আর সময় খরচ করতে দু’বার চিন্তা করে না – সেখানে আইরিন কোন ধরনের প্রসাধন তো দূরের কথা ভালো কোন ড্রেসও কিনেনি কখনো। ঢিলেঢালা আরামদায়ক ও কাজ করতে সুবিধাজনক পোশাকই আইরিনের পছন্দ। তার জামার হাতায় পকেট থাকতো রুমাল রাখার জন্য। সময় বাঁচাবার জন্য তার সুন্দর কোঁকড়া চুল সে নিজেই কেটে ছোট করে রাখতো।

১৯১৪ সালের গ্রীষ্মকালে মাদাম কুরি লা’আরকোয়েস্টের সমুদ্রের তীরে একটি বাসা ভাড়া করেন। ঐ জায়গাটা সমুদ্রের তীরে ছোট্ট একটা জেলে-পল্লী। সরবোন ইউনিভার্সিটির প্রফেসররা জায়গাটা এত পছন্দ করতেন যে ওখানকার সৈকতের নামই হয়ে গেল সরবোন বিচ। ছোট ছোট মাছ ধরার নৌকায় চড়ে মাছ ধরতে পছন্দ করতেন অনেকে।

১ম বিশ্বযুদ্ধের পাঁয়তারা চলছে ইউরোপে। মাদাম মেয়েদের নিরাপত্তার খাতিরে আইরিন আর ইভকে গভর্নেসের সাথে লা’আরকোয়েস্টের বাসায় পাঠিয়ে দিলেন। আইরিন ও ইভ সেখানে সমুদ্রের তীরে ঘুরে বেড়ায়। সন্ধ্যাবেলা বসে গভীর মনযোগে পড়াশোনা করে। সরবোন ইউনিভার্সিটিতে বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে সে।

যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। মেরি কুরি প্যারিস থেকে আইরিনকে চিঠি লিখলেন, “মনে হচ্ছে অবস্থা আরো খারাপ হবে। আইরিন, আমাদের দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তৈরি থাকতে হবে।”

সেপ্টেম্বরে জার্মানি বেলজিয়াম আক্রমণ করলো। সেখান থেকে প্যারিসের দিকে আসতে শুরু করলো। লা’আরকোয়েস্টে আইরিন ও ইভকে পোলিশ ভাষায় কথা বলতে শোনার পর অনেকে তাদেরকে জার্মান স্পাই সন্দেহে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলো। তাতে আইরিন খুবই মন খারাপ করে মাকে চিঠি লিখলো – “আমাকে যারা জার্মান স্পাই বলছে তারা ফ্রান্সকে যতটুকু ভালোবাসে তাদের চেয়ে কোন অংশে কম ভালোবাসি না আমি ফ্রান্সকে। ফ্রান্স আমার জন্মভূমি। সবকিছুর চেয়েও বেশি আমি ফ্রান্সকে ভালোবাসি। আর আমাকেই কিনা বলে জার্মান স্পাই! মা, আমি প্যারিসে ফিরতে চাই এখনই।”

উত্তরে মেরি লিখলেন – “আইরিন, তুই যদি এখন ফ্রান্সের জন্য কাজ করার সুযোগ না পাস – ভবিষ্যতের ফ্রান্সের জন্য কাজ করার প্রস্তুতি নিতে থাক। এই যুদ্ধে হয়তো ফ্রান্সের অনেককেই আমরা হারিয়ে ফেলবো। তখন তাদের জায়গায় তোদেরকেই কাজ করতে হবে। মন দিয়ে ফিজিক্স আর ম্যাথ্‌স পড়তে থাক।”

তার দু’সপ্তাহ পর আইরিন আর ইভকে প্যারিসে নিয়ে এলেন মাদাম কুরি। যুদ্ধের সময় রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের তেজষ্ক্রিয় রেডিয়াম যদি জার্মান সৈন্যরা পায় তাহলে খুব ক্ষতি হয়ে যাবে। মাদাম নবনির্মিত রেডিয়াম ইনস্টিটিউট রক্ষা করার প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। আইরিন যথাসম্ভব সাহায্য করছিল মায়ের কাজে।

যুদ্ধের প্রথম দশ দিনের মধ্যেই প্রায় তিন লাখ ফরাসি সৈন্য নিহত হয়, আহত হয় আরো বেশি। যুদ্ধাহত সৈনিকদের শরীর থেকে বুলেট বের করে আনতে আর্মি-সার্জনদের অনেক সমস্যা হয়। শরীরের নানা জায়গায় অস্ত্রোপচার করতে হয় – ফলে অনেক সময় সৈন্যদের প্রাণ বাঁচানো যায় না। মাদাম কুরি একটা উপায় বের করলেন। শরীরে বুলেটের অবস্থান নির্ণয় করার জন্য এক্স-রে ব্যবহার করা যায় কিনা দেখলেন তিনি।

এক্স-রে’র বয়স তখন মাত্র পনেরো বছর। এক্স-রে তৈরি ও রেডিওগ্রাফ প্রযুক্তির সূচনা হয়েছে মাত্র। মাদাম কুরি মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং ও হেল্‌থ ইউনিটকে কাজে লাগিয়ে বিশটি এক্স-রে ইউনিট তৈরি করালেন। দুর্গম যুদ্ধক্ষেত্রের অস্থায়ী হাসপাতালে বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকে না। মেরি কুরি বিশটি ছোট ট্রাকের মধ্যে জেনারেটর সহ এক্স-রে ইউনিট বসিয়ে এরকম হাসপাতালে সরবরাহ করার ব্যবস্থা করলেন।

যুদ্ধাহতদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য ফরাসি মেয়েরা নার্সিং ট্রেনিং নিচ্ছিলো। আইরিনও নার্সিং ট্রেনিং নিলো। ইতোমধ্যে মাদাম গাড়ি চালানো শিখে নিয়েছেন। আইরিনকে সাথে নিয়ে নিজে ভ্রাম্যমান এক্স-রে ইউনিট চালিয়ে দুর্গম হাসপাতালে পৌঁছে যান তিনি। এক্স-রে মেশিন সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক জ্ঞান তিনি আইরিনকে দেন গাড়ি চালাতে চালাতেই। আইরিন দ্রুত শিখে নেয় সব।

জটিল সার্জিক্যাল কেস এলেই মাদাম কুরির ডাক পড়ে। একবার এরকম এক ব্যারাকের হাসপাতালে যাবার সময় চেকপোস্টে মিলিটারিরা মাদামের গাড়ি থামায়। একজন সার্জেন্ট গাড়ির কাছে এসেই মাদামকে চিনতে পারে। স্যালুট দিয়ে বলে, “এতো আমাদের মাদাম কুরি আর লিটল কুরি”। আইরিন ভাবলো সার্জেন্ট তাকেই ‘লিটল কুরি’ বলেছে। কিন্তু মাদাম বললেন, “আমার গাড়িগুলোকে তারা লিটল কুরি বলে ডাকে”।

১৯১৫ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আইরিনের বয়স আঠারো হবার পর মাদাম তাকে কয়েকটা এক্স-রে ইউনিটের দায়িত্ব দিয়ে দিলেন। এক্স-রে ইউনিট বসানো, সার্জনকে রোগীর এক্স-রে নিতে সাহায্য করা, সৈনিকদের এক্স-রে মেশিন চালানোর ট্রেনিং দেয়া সব করতে লাগলো আইরিন একা। যুদ্ধাহত সৈনিকেরা পরমা সুন্দরী আইরিনকে সত্যি সত্যিই গ্রিক শান্তির দেবী ‘আইরিন’ হিসেবেই দেখতে শুরু করলেন।

আমেরিকান সৈন্যরা ফ্রান্সে এসেছে যুদ্ধে সহায়তা করার জন্য। তারাও যোগ দেয় আইরিনের ট্রেনিং ক্লাসে। তরুণ সৈন্যরা আইরিনকে দেখে চোখ ফেরাতে পারে না। তাদের মধ্যে হুড়োহুড়ি লেগে যায় আইরিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। কিন্তু স্বভাব-গম্ভীর আইরিন ট্রেনিং দেবার সময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটা শব্দও উচ্চারণ করে না।

যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই ফরাসি সৈনিকেরা বুঝতে পেরেছেন মাদাম কুরি ও রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের গুরুত্ব কতখানি। তারা রেডিয়াম ইনস্টিটিউটকে সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য চারপাশে বালির বস্তা দিয়ে বাংকার তৈরি করে ট্যাংক নিয়ে পাহারা বসালো। সুন্দর নতুন বিল্ডিং-এর চারপাশে এরকম বিশ্রী বালির বস্তা দেখে আইরিনের মন খারাপ হয়ে গেল। সে বালির বস্তার ওপর সুন্দর করে ফুলের টব বসিয়ে দিলো।

১৯১৮ সালে যুদ্ধ শেষ হবার পর আইরিনকে মিলিটারি মেডেল প্রদান করা হয় যুদ্ধে তার অবদানের জন্য। কিন্তু মাদাম কুরিকে কোন রাষ্ট্রীয় সম্মান দেয়া হলো না।

কিছুদিন পর সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে আইরিন। আরো দু’বছর পর পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন আইরিন।

[পর্ব ০২].

[মেরি কুরি ও আইরিন কুরির কাহিনি এবারের বইমেলায় আমার ‘রেডিয়াম ভালোবাসা’ বইতে প্রকাশিত হয়েছে। সাধারণত আমার লেখাগুলো আগে মুক্তমনায় প্রকাশিত হয়, পরে বই আকারে মুদ্রিত হয়। কিন্তু আইরিন কুরির কাহিনি আগে মুক্তমনায় প্রকাশিত হয়নি। প্রশ্ন করা যায় – বইতে প্রকাশিত হবার পর তা মুক্তমনায় আবার প্রকাশের দরকার কী? দরকার যে একেবারেই নেই তা বলা যাবে না। কারণ অনেক পাঠক আছেন যাঁরা দেশের বাইরে থাকেন, নিয়মিত পড়েন, কিন্তু মুদ্রিত বই তাঁদের হাতে পৌঁছানোর জন্য অনেক কাঠ-খড়-গ্যাস-ইলেকট্রিসিটি-ডলার-পাউন্ড পোড়াতে হয় – যা আমার প্রকাশক কিছুতেই করতে রাজি নন। তাছাড়া দেশের ভেতরেও যাঁরা আছেন – তাঁদের অনেকের কাছেও বই পৌঁছায় না। আমাদের দেশে ফ্রেব্রুয়ারির বই মেলায় যেরকম উৎসাহের আতিশয্য দেখা যায় – মেলা ভাঙার ঠিক পরদিনই সেই উৎসাহের মৃত্যু ঘটে। বইগুলোর আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় না। কিছু কিছু ব্যতিক্রমী প্রকাশক নিশ্চয় আছেন, কিন্তু আমার প্রকাশকেরা ঠিক সেই কাতারে দাঁড়াতে উৎসাহী নন। তাই আমার মুদ্রিত-অমুদ্রিত সব লেখাই মুক্তমনায় উন্মুক্ত হবে এটাই আমি স্বাভাবিক বলে মনে করি।]