পানীয় হিসাবে চায়ের প্রচলন হয়েছে বহু প্রাচীন কালে। চিন, জাপানের লোকেরা সুপ্রাচীনকাল থেকে চা পান করে আসছে। ব্রিটিশদের চা পান সেই তুলনায় অনেক নতুন। মাত্র কয়েকশ’ বছর আগে থেকেই এই নেশায় মেতেছে তারা।

মূলতঃ চিন থেকে আমদানি করা চা দিয়ে কাজ চালাতো ব্রিটিশরা। কিন্তু, তাদের নিজেদের মাটিতেই যে গুপ্তধন লুকিয়ে রয়েছে, সে খবর তারা জানতো না।

১৫৯৮ সালে ডাচ পরিব্রাজক লিনচোটেন তাঁর বইতে লেখেন যে, ভারতীয়রা এক ধরণের গাছের পাতাকে রসুনের সাথে মিশিয়ে সবজি হিসাবে খায়। আবার কখনো কখনো সেই পাতাগুলোকে সিদ্ধ করে পানীয় তৈরি করে।

১৭৮৮ সালে বৃটিশ বোটানিস্ট জোসেফ ব্যাং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে জানায় যে, বৃটিশ অধ্যুষিত উত্তরপূর্ব ভারতের কিছু এলাকা চা উৎপাদনের জন্য আদর্শ জায়গা। চিন থেকে চা গাছের চারা এনে এখানে লাগানোর সুপারিশ করেন তিনি। ভদ্রলোক জানতেন না যে চিন থেকে চারা আমদানির কোনো প্রয়োজন নেই। চা গাছ বাংলা এবং আসামে বহু আগে থেকেই জন্মে চলেছে। ভদ্রলোকের ঐ সুপারিশে অবশ্য কেউ-ই কর্ণপাত করে নি।

১৮২৩ সালের পরে দৃশ্যপটে আসেন দুই ব্রুস ব্রাদার। রবার্ট ব্রুস এবং চার্লস ব্রুস। এই দুই ভাই জাতিতে স্কটিশ। দুজনেই এডভেঞ্চারপ্রিয়। রোমাঞ্চিত জীবনের আশায় দুজনেই অল্প বয়সে ঘর ছেড়ে বাইরে চলে আসেন। রবার্ট যোগ দেন ব্রিটিশ আর্মিতে আর চার্লস নৌবাহিনীতে। ১৮২৩ সালে ঘটনাচক্রে দুজনেই চলে আসেন আসামে।

রবার্টের পরিচয় ঘটে মণিরাম দেওয়ান নামের এক তরুণের। এই তরুণই তাঁকে বলে যে স্থানীয় সিংপু গোত্রের লোকেরা এক ধরণের গাছের পাতা থেকে পানীয় বানিয়ে খায়। রবার্ট একে ধরে সিংপু গোত্রের চিফের কাছে পৌঁছান। সেখান থেকে তিনি নমুনা সংগ্রহ করে কোলকাতায় পাঠান এর পরিচয় পাবার উদ্দেশ্যে।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন এককভাবে চিন থেকে চা আমদানি করতো। বাণিজ্যে একক আধিপত্য থাকার কারণে তার উপেক্ষা করে যায় রবার্টের এই উদ্যোগকে।
পরের বছর দুর্ভাগ্যক্রমে রবার্ট মারা যান। চার্লস রবার্টের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে।

১৮৩৩ সালে পরিস্থিতি পালটে যায় পুরোপুরি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চিন থেকে চা আমদানির একচ্ছত্র অধিকার হারায়। বিকল্প লাভজনক পন্থা হিসাবে ভারতকে বেছে নেওয়া হয়। একটা কমিটি গঠন করা হয় এবং চার্লস ব্রুসকে দায়িত্ব দেওয়া হয় নার্সারি খোলার জন্য। কমিটির সেক্রেটারিকে চিনে পাঠানো হয় আশি হাজার বীজ নিয়ে আসার জন্য। কারণ, তখন পর্যন্তও তারা নিশ্চিত ছিলেন না যে চা গাছ ভারতেরই নিজস্ব উদ্ভিদ।

এই বীজগুলোকে লাগানো হলো কোলকাতার বোটানিকাল গার্ডেনে। বীজ থেকে চারা বের হলো। সেগুলো যখন একটু শক্তপোক্ত হলো, তখন পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলো আসামে।

এর মধ্যে চার্লস ব্রুস বাগান করার সব ব্যবস্থা করে ফেলেছেন আসামে। দুজন দক্ষ চা গাছ বিশেষজ্ঞকে নিয়োগ দিয়েছেন চিন থেকে এনে। এদের সহযোগিতায় তিনি শিখে নিচ্ছেন চা বাগান বানানোর সব গোপন কলাকৌশল।

কোলকাতার বোটানিকাল গার্ডেন থেকে চার আনা হলো। লাগানো হলো বাগানে। দেশিয় চা গাছও রয়েছে বাগানে। আসামের আবহাওয়া চরম ধরণের। গ্রীস্মকালে চরম গরম, শীতকাল ভয়াবহ ঠাণ্ডা। এই চরম আবহাওয়ার সাথে যুদ্ধে হেরে গেলো চিনের চা গাছের চারাগুলো। ওদের বদলে অবহেলিত দেশি গুলোই ফুলে ফেঁপে উঠতে লাগলো। এর মধ্যে বিপদ হলো আরেকটা। চিনে চা গাছের সাথে দেশিয় গাছের মিশ্রণে তৈরি হয়ে গেলো এক সংকর। এর মান খুবই অনুন্নত।

চাইনিজ চারার এই করুণ দশা দেখে দেশিয় গাছের দিকেই পুরোপুরি মনোযোগ দিলেন চার্লস ব্রুস। আসাম থেকে খাঁটি দেশিয় চা লন্ডনে গেলো ১৮৩৮ সালে। সেই চা সমাদরেই গৃহীত হলো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আসামে খবর পাঠালো এই বলে যে, বেশ কিছু গণ্যমান্য লোক এই চা খুবই পছন্দ করেছে।

এর পরই আসামে চা বাগানের হিড়িক পড়ে যায়। বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদন শুরু হয়ে যায় ব্যাপকভাবে।

চা বাগানতো চালু হলো। এখন সমস্যা দাঁড়ালো কুলি-মজুর জোগাড় করা। আসামের প্রকৃতি সোনা ফলা। কৃষকদের কোনো গরজ নেই চা বাগানে কাজ করার। আর তাছাড়া চা বাগানে কাজ করাটাও বিপদসংকুল এবং শ্রমসাধ্য। এই জঙ্গল-ভূমির চারিদিকে বাঘ, চিতা, হায়েনার আনাগোনা। মাঝে মাঝে কিছু পাহাড়ি জংলী গোত্রের লোকেরাও এসে আক্রমণ চালায় পরম সহিংসতা নিয়ে। এই পরিস্থিতে স্থানীয় শ্রমিক পাওয়া দুরূহ হয়ে দাঁড়ালো।

সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো শ্রমিক আনা হবে আসামের বাইরে থেকে। সাহেবরা দালালদের মাধ্যমে ভুলিয়ে ভালিয়ে মূলত বিহারের ছোট নাগপুর থেকে নিয়ে এলো কুলিদের। এর বাইরে উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ থেকেও আনা হলো তাদের। এখানে আসার পরে তারা টের পেলো যে ভুলিয়ে ভালিয়ে মরণফাঁদে এনে ফেলা হয়েছে তাদের। ফেরার আর কোনো উপায় নেই। চাবুকের নীচে দাসশ্রম দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তাদের। এই দাসশ্রম দিতে গিয়ে চরম বৈরি পরিবেশে অকাতরে জীবন দিয়েছে তারা। অন্যের চিত্ত আনন্দময় করার জন্য, অন্যের বিত্ত বৈভব বাড়ানোর জন্য, নিজের নিত্য বলি দিয়েছে তারা। সরকারী হিসাবে থেকেই জানা যায় যে, প্রথম তিনবছরের মধ্যে আসামে যে ৮৪,৯১৫ জন মজুর আমদানী করা হয়েছিলো তার ভিতর ৩১,৮৭৬ জনই অত্যাচার, নির্যাতন, অনাহার, অর্ধাহার আর মরণ ব্যাধির কবলে পড়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলো।

এই কর্ম, ঘর্ম আর রক্তের লাল ইতিহাস, এই বর্বরতার চিহ্ন, এই নিষ্ঠুরতার কাহিনি মজুরেরা নিয়ে এসেছে গানে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের নিঠুর ফাঁকিবাজির ইতিহাসকে তারা ছড়িয়ে দিয়েছে ঝুমুর গানের মাধ্যমে। সেরকমই একটি গান এখানে তুলে দিলাম। এ শুধু গান নয়, এর প্রতিটি শব্দের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে বঞ্চনার ব্যথা, নিষ্ঠুরতা আর নির্মমতার কথা, প্রতারণা আর ফাঁকিবাজির গল্প, অচেনা ভূমিতে অন্যের আনন্দ জোগানের জন্য নিজদের রক্ত আর প্রাণ ত্যাগের কাহিনি, আছে প্রাণান্ত পরিশ্রম আর প্রবল প্রতিপক্ষের কাছে অসহায় এবং হতদরিদ্র মানুষের পরাভব মানার পূর্ণ চিত্রায়ন।

ফাঁকি দিয়া আনিলি আসাম;
রে নিঠুর শ্যাম;
চাউলভাজা চায়ের পানি বাঁচাইল পরান।
সাহেব বলে কাম কাম
বাবু বলে ধইরে আন
সর্দার বলে লিব পিঠের চাম
রে, নিঠুর শ্যাম।
ফাঁকি দিয়া আনিলি আসাম।

———————————————————

এই গানটা ইউটিউব থেকে খুঁজে বের করে দিয়েছেন ভজন দা। গানের কথার অবশ্য বেশ খানিকটা হেরফের আছে। আমি গানের লিরিকস নিয়েছি হেমাঙ্গ বিশ্বাসের বই  ‘গানের বাহিরানা’ থেকে। কাজেই, কোনটা আসল লিরিকস বলতে পারছি না।

httpv://www.youtube.com/watch?v=XoE7p_USoXk#t=314