ইয়ারার তীরে মেলবোর্ন [০১] [০২] [০৩] [০৪] [০৫] [০৬] [০৭] [০৮] [০৯] [১০][১১][১২][১৩][১৪][১৫]

১৬
২৩ জুলাই ১৯৯৮ বৃহস্পতিবার
উইলির ফ্ল্যাট

“গুডামাইট, হাউ ইউ ডুইং?”
ডক্টর জেফ সুইটের পরনে আজও হাফ-প্যান্ট আর হাফ শার্ট। ল্যাবোরেটরির নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় এরকম পোশাক আরামদায়ক, কিন্তু বাইরে বেরোলেই তো ঠান্ডায় জমে যাবার কথা। অনুভূতির ব্যাপারটা মনে হয় সময়ের সাথে বিপরীতানুপাতিক। সময় যত কাটতে থাকে, অনুভূতির তীব্রতা কমতে থাকে। মেলবোর্নের এই সকালে চার-পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা আমার কাছে যতটা হাড়-কাঁপানো, জেফের কাছে ততটা নয়। কারণ এই ঠান্ডার সাথে জেফের বসবাস কমপক্ষে ষাট বছর আর আমার কাটছে মাত্র ষোল দিন।

‘গুডামাইট’ শব্দটা আরো অনেকবার শুনেছি। গতকাল জেফ কেন্‌কে বলেছিলেন ‘গুডাকেন্‌’। একটু ভাবতেই পরিষ্কার হয়ে গেলো শব্দটা। ‘গুডা’ মানে গুড ডে। ‘গুডাকেন্‌ – গুড ডে কেন্‌। আর ‘গুডামাইট’- গুড ডে মেইট। শুধুমাত্র উচ্চারণের কারণে শব্দ কীভাবে বদলে যায়।

ভদ্রতার দায় অনেক রকম। এই যে জেফ জানতে চাইলেন আমার দিনকাল কেমন যাচ্ছে তা শুধু ভদ্রতার দায়ে। নইলে আমার জবাব শোনার জন্য অপেক্ষা করতেন। কিন্তু তিনি এখন একটা স্পেকট্রোমিটারের কলকব্জা খোলায় ব্যস্ত। আমার অনেক কষ্টে তৈরি করা উত্তর ‘আই এম ফাইন, হাউ আর ইউ জেফ?’ বৃথা গেলো।

ফার্স্ট ইয়ার ফিজিক্স ল্যাবে এসেছি নিকের সাথে দেখা করতে। আসার আগে কম্পিউটার ল্যাবে গিয়ে মার্কের কাছ থেকে ল্যাবের ইলেকট্রনিক এক্সেস সেট করে নিয়ে এসেছি। এখন থেকে যে কোন সময় এই ল্যাবে ঢুকতে পারবো। নিকের সাথে দেখা করে জেনে নিতে হবে আমাকে কোন্‌ কোন্‌ এক্সপেরিমেন্ট দেয়া হয়েছে।

জেফের কাছ থেকে জেনে নিয়ে চারতলায় উঠলাম। নিকের অফিস চারতলায় সেকেন্ড ইয়ার ফিজিক্স ল্যাবের একদম শেষ প্রান্তে। ল্যাবের সারি সারি যন্ত্রপাতি সজ্জিত ডেস্কের মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাবার সময় অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছিল। এরকম সুসজ্জিত ল্যাবোরেটরি আগে কখনো দেখিনি। এখন হঠাৎ একেবারে হাতের নাগালে চলে এসেছে বলেই উত্তেজনার প্রাথমিক ধাক্কাটা এমন জোরে লাগছে।

নিক নিকোলা- ল্যাবোরেটরি টেকনিশিয়ান। ফার্স্ট ইয়ার আর সেকেন্ড ইয়ারের ল্যাব দেখাশোনা করেন। কলিনের অফিসের মতই হলুদ দেয়াল ঘেরা নিকের অফিস। আমাকে দেখে বেরিয়ে এলেন নিক। সাদা এপ্রোন পরা পৌনে পাঁচ ফুট উচ্চতার নিক নিকোলার ভাবভঙ্গি ব্যস্ত ডাক্তারের মত।

“হাউ কেন আই হেল্প ইউ?”
এক্সপেরিমেন্ট সম্পর্কে জানতে এসেছি শুনে বললেন, “ডোন্ট বি সো সিরিয়াস মাই ফ্রেন্ড”। এত সিরিয়াস হবার কিছু নেই। আগামী সপ্তাহের মধ্যে এক্সপেরিমেন্ট সেট হয়ে যাবে। তার পরের সপ্তাহ থেকে ল্যাব শুরু। তার আগে যে কোন সময়ে এসে এক্সপেরিমেন্টগুলো নিজে নিজে একবার করে নিলেই হবে।

তিন তলায় এসে ল্যাবের পাশের স্টাফ রুম দেখালেন নিক। এখানে ল্যাব-প্ল্যান আছে। দেখলাম আমাকে ইলেকট্রিসিটি এণ্ড ম্যাগনেটিজম ল্যাব দেয়া হয়েছে চার সপ্তাহের জন্য। প্রথম ক্লাস আগস্টের ছয় তারিখ। এখনো দু’সপ্তাহ বাকি। নিকের কথাই ঠিক- এত সিরিয়াস হবার কিছু নেই। তবে কম্পিউটারের কিছু ব্যাপার শিখে নেয়া দরকার। কারণ ল্যাবে স্টুডেন্টদের প্রত্যেকের জন্যই একটা করে কম্পিউটার আছে এবং তারা ডাটা এনালাইসিসের জন্য কম্পিউটার ব্যবহার করে। নিজে না জেনে অন্যকে শেখাতে যাবার মত দুঃসাহস আমার নেই।

কম্পিউটার ল্যাবে তিনটা পর্যন্ত কাটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। একটা কান ঢাকা টুপি কিনেছি দু’ডলারের দোকান থেকে। বেশ ভালো কাজ দিচ্ছে। লাইগন স্ট্রিট ধরে হাঁটতে হাঁটতে কুইন্সবারি স্ট্রিটে এসে বামে মোড় নিলাম। হাঁটতে হাঁটতে রয়েল এক্সিবিশান সেন্টার। মেলবোর্ন শহরের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান।

১৮৮০ সালে তৈরি এই বিল্ডিংটা মেলবোর্নের অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। ১৮৮১ সালে মেলবোর্ন ইন্টারন্যাশনাল এক্সিবিশান অনুষ্ঠানের জন্য এই ভবন তৈরি করা হয়েছিল। এর প্রধান ভবনটির ক্ষেত্রফল বারো হাজার বর্গমিটারেরও বেশি। ১৯০১ সালে অস্ট্রেলিয়া যখন সবগুলো স্টেট নিয়ে অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেশান গঠন করে, মেলবোর্ন থেকেই শুরু হয় তার কার্যক্রম। অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেশানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়েছিল এই রয়েল এক্সিবিশান বিল্ডিং-এ। পরে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত ভিক্টোরিয়ান স্টেট গভর্নমেন্টের কার্যক্রম চলে এখানে।

বিরাট গম্বুজ ওয়ালা বিল্ডিংটার চারপাশে বাগান আর খালি জায়গা মিলিয়ে বিশাল কার্লটন গার্ডেন। ঘাসে ঢাকা লন আর বড় বড় গাছ চারদিকে। বেশির ভাগ গাছের পাতা ঝরে গেছে। নতুন বসন্তে নতুন পাতা গজাবে কয়েক মাস পর।

ছোট্ট একটা ঝিলে বেশ কিছু হাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে। আমাদের দেশের হাঁসের মতই অতি সাধারণ হাঁস। বেশ কিছু কুকুর দেখা যাচ্ছে। তাদের গলায় লাগানো লম্বা বেল্ট ধরে দ্রুত হাঁটছেন তাদের মালিকেরা। খুব মনযোগ দিয়ে ব্যাপারটা দেখলাম কিছুক্ষণ। বুঝতে চেষ্টা করলাম কুকুর চরানোর ব্যাপারটা কত কঠিন। দেখে মনে হচ্ছে খুব একটা কঠিন কাজ নয়। তবে কুকুর যখন পার্কে পায়খানা করে তখন পকেট থেকে প্লাস্টিকের ব্যাগ বের করে কুকুর-কর্ম সংগ্রহ করে পার্কের রাবিশ বিনে ফেলতে হয়। এই ব্যাপারটা একটু অস্বস্তিকর।

কুকুরেরা যে আমাকে বিশেষ পছন্দ করে না তার প্রমাণ ছোটবেলা থেকে অনেকবার পেয়েছি। মেলবোর্নে এসেও যে কুকুর কর্তৃক তাড়িত হয়েছি তা তো তুমি জানো। তারপরও কুকুরের প্রতি আজ একটু মনযোগ দিচ্ছি কারণ একটু পরে একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাবো যেখানে কুকুরের একটা ভূমিকা আছে।

বিজ্ঞপ্তিটা চোখে পড়েছে আজ সকালে পাউরুটি কেনার জন্য সেফওয়েতে যাবার পথে। কার্লটন কোর্টে ঢোকার সময় বাম পাশের দেয়ালে বেশ বড় একটা বোর্ড আছে হরেক রকমের লোকাল বিজ্ঞাপনে ভর্তি। “ডগ ওয়াকার ওয়ান্টেড”। ডগ ওয়াকিং মানে কুকুর হাঁটানো! গরু-ছাগল চড়ানোর মত কুকুর চরানো। ঘন্টায় ছয় ডলার। প্রতিদিন বিকেলে দু’ঘন্টা। চাকরিটার প্রতি প্রয়োজনের চেয়েও কৌতূহল বেশি অনুভব করছি। একটা বিচিত্র রকমের কাজের অভিজ্ঞতা হলে মন্দ কী।

বাসা খুঁজে পেতে সমস্যা হলো না। পার্কের ওপাড়েই টাউন হাউজের নিচের তলায় ৬৭ নম্বর বাসা। ঠিক চারটায় দরজায় নক করলাম। দুপুরে ফোন করেছিলাম মিসেস হাডসনকে। বিজ্ঞপ্তিতে ওই নামটাই ছিল। গলা শুনে বুঝেছি বেশ বয়স হয়েছে ভদ্রমহিলার। কিন্তু দরজা খোলার পর যাঁকে দেখলাম – মনে হচ্ছে তাঁর বয়স আরো অনেক বেশি।

হুইল চেয়ারে বসে আছেন বিশাল মোটা একজন মানুষ। হঠাৎ দেখে মানুষ বলে বোঝা যায় না। তালতাল থলথলে মাংসের স্তূপ। নিজের শরীরের কাছে মানুষ যে কত অসহায়!

“মিসেস হাডসন?”
“ইয়েস” কন্ঠস্বরে যথেষ্ঠ জোর আছে মিসেস হাডসনের।
“গুড আফটারনুন মিসেস হাডসন। আই এম হিয়ার ফর ডগ ওয়াকিং”
কুকুর চরানোর জন্য এসেছি শুনে মিসেস হাডসন তাঁর যন্ত্রচালিত হুইল চেয়ার পেছনে সরিয়ে বললেন,
“প্লিজ কাম ইন। হ্যাভ এ সিট”

ছোট্ট বসার ঘর। একপাশের দেয়ালে লাগানো একটা থ্রি-সিটার সোফা। সোফার গদি বেশ পুরনো বিবর্ণ। ঘরের কোণায় একটা পুরনো টিভি চলছে। শব্দ কমানো। অন্যদিকের দেয়ালে রুম-হিটার জ্বলছে। হিটারের সামনে মেঝের কার্পেটে শুয়ে আছে একটা প্রাণী।

মিসেস হাডসন গলা উঁচিয়ে ডাকলেন “জনি, জনি”
জনি নামের কেউ কোন সাড়াশব্দ করলো না। এবার বিরক্ত হয়ে উঠলেন মিসেস হাডসন। হুইল চেয়ার চালিয়ে নিয়ে হিটারের সামনে শুয়ে থাকা প্রাণীটার গায়ের ওপর তুলে দিলেন প্রায়। এবার ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়ালো প্রাণীটা। এরকম বিশ্রি কুকুর আমি জীবনেও দেখিনি। কুকুরটা মনে হচ্ছে তার মালিকের সাথে মোটা হবার প্রতিযোগিতায় নেমে ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। হনুমানের মত কুচকুচে কালো মুখের দু’পাশ থেকে লালা গড়িয়ে পড়ছে।

“এই হলো জনি। আগে খুব করিৎকর্মা ছিল। এখন আমার হাঁটা-চলা বন্ধ হবার পর থেকে জনির হাঁটা-চলাও বন্ধ হয়ে গেছে। তাই এই অবস্থা তার” – বর্ণনা করছেন মিসেস হাডসন।

এদেশের ছেলে-মেয়েরা আঠারো বছর হতে না হতেই মা-বাবাকে ছেড়ে যে যার মতো চলে যায়। মা-বাবা তখন কুকুর পোষেন। অপত্য স্নেহ ঝরে পড়ে পোষা প্রাণীর ওপর। অনেক সময় পোষা কুকুর তার প্রভুর উপকার করে, বোঝা টানে। কিন্তু মিসেস হাডসনের পোষা কুকুর জনি নিজেই বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

“তোমার নিজের কোন কুকুর আছে?”
“জ্বি না ম্যাডাম”
“কুকুর হাঁটানোর অভিজ্ঞতা আছে?”
কুকুর হটানোর অভিজ্ঞতা আছে, কিন্তু হাঁটানোর তো নেই। বললাম, “জ্বি না ম্যাডাম”
“জনিকে হাঁটাতে পারবে? প্রতিদিন দু’ঘন্টা করে না হাঁটালে জনির মেদ কমবে না। চেষ্টা করে দেখো তোমার সাথে জনির ভাব হয় কি না। এই নাও তার বেল্ট। পরাতে পারো কি না দেখো”

মিসেস হাডসন স্টিলের কাঁটা লাগানো একটা বেল্ট ছুঁড়ে দিলেন আমার দিকে। জনির দিকে তাকালাম। ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে আছে। মুখ দিয়ে লালা গড়াচ্ছে এখনো। এটার গলায় বেল্ট পরানো আমার কম্মো নয়। কিন্তু চেষ্টা না করেই ছেড়ে দেবো? বেল্টটা নিয়ে জনির গলার দিকে হাত বাড়ালাম। জনি নড়লো না একটুও, কিন্তু জিভ বের করে আমার হাতটা চেটে দিলো। বেল্ট লাগাতে লাগাতে থিকথিকে ঘন লালায় হাত ভরে গেলো আমার।

মিসেস হাডসন বুঝতে পারছেন আমার অবস্থা। বললেন, “ইউ নেভার হ্যান্ডেল এ ডগ বিফোর। লিভ ইট এলোন ইফ ইউ কান্ট”। অপমানে আমার কান গরম হয়ে গেলো। সামান্য একটা কুকুরের গলায় বেল্ট বাঁধতে পারছি না বলেই কি অপমান লাগছে? সবাই সব কাজ করতে পারবে এমন তো কথা নেই। অপ্রিয় সত্য কথা যত সহজভাবে হজম করা যায় ততই ভালো। তবুও একবার শেষ চেষ্টা করলাম। জনির গলার বেল্ট ধরে হ্যাঁচকা টান দিলাম। টানটা একটু জোরে হয়ে গেলো। জনি হঠাৎ এমন ভয়ংকর চিৎকার করে তেড়ে এলো আমার দিকে- আমি সবকিছু ভুলে খোলা দরজা দিয়ে এক লাফে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। তারপর দৌড় আর দৌড়। জনি আমার পিছু নিলে একদিনেই তার মেদ অনেক ঝরে যেতো।

২৪ জুলাই ১৯৯৮ শুক্রবার
উইলির ফ্ল্যাট

সারা সকাল চারতলার কম্পিউটার রুমে কাটিয়ে দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে অফিসে ঢুকতেই ম্যান্ডি বললো, “ইওর ফাদার কল্‌ড”

আমার বাবা ফোন করেছিলেন! অসম্ভব। বাবার টেলিফোন ব্যবহারের কোন সুযোগ নেই। তবে কি কেউ টেলিফোন করে বাবার ব্যাপারে কিছু বলেছে? দুর্বল মনের স্বভাবই হলো দুঃসংবাদের আশঙ্কা করা। বাবার শরীর ভালো নেই দেখে এসেছি। আতঙ্কে অস্থিরতায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড়। কোন রকমে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এনি ম্যাসেজ?’

“হি সেড হি উইল কল ইউ এগেন”
কে ফোন করতে পারে? অজিত ফোন করলে তো নাম বলবে। ফোনের কাছে বসে রইলাম। সময় যেন থেমে গেছে। মন বসছে না কিছুতেই। একটার দিকে ফোন বেজে উঠলো। প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ফোন ধরলাম।
“হ্যালো”
“ইজ ম্যান্ডি দেয়ার?” একটা পুরুষ কন্ঠ ম্যান্ডিকে চাইছে। তারপর পুরো একঘন্টা ফোন ছাড়লো না ম্যান্ডি। আমি যে একটা জরুরী ফোনের জন্য অপেক্ষা করছি তা কি ম্যান্ডির বোঝা উচিত নয়?

অবশেষে দুটোর দিকে ফোন রেখে “বাই বাই, হ্যাভ এ নাইস উইকএন্ড” বলে চলে গেলো ম্যান্ডি। রুমে আর কেউ নেই। অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছি তো করছিই। ফোনটা এলো আড়াইটার দিকে।
“হ্যালো”
“প্রদীপ, ভালো আছো?”
“জ্বি স্যার, ভালো আছি”
“সকালে একবার ফোন করেছিলাম। তুমি ছিলে না। একটা মেয়ে ফোন ধরেছিল। তোমার কলিগ মনে হয়”

এতক্ষণে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আলী সাহেবই ফোন করেছিলেন। কিন্তু ম্যান্ডি যে কেন তাঁকে আমার বাবা ভেবে বসলো জানি না।
“আচ্ছা তোমার বাসার ঠিকানাটা বল তো”
আলী সাহেব আমার বাসার ঠিকানা জানতে চাচ্ছেন! ব্যাপার কী? বাসায় ওঠার আগে তাঁকে জানিয়েছিলাম ঠিকানা। নিশ্চয় হারিয়ে ফেলেছেন। বললাম। ঠিকানা লিখতে লিখতে জিজ্ঞেস করলেন,
“পার্কিং এর কী ব্যবস্থা ওখানে?”
“বিল্ডিং এর সামনে অনেকগুলো গাড়ি রাখার জায়গা আছে”
“সন্ধ্যাবেলা একবার আসবো তোমার বাসায়। ছ’টা সাড়ে ছ’টার দিকে। বাসায় থেকো ওই সময়”
ফোন রেখে দিলেন আলী সাহেব।

এক ধরনের মিশ্র অনুভূতি নিয়ে বাসায় চলে এলাম। আমি কীভাবে থাকছি দেখতে আসছেন আলী সাহেব। আমার তো খুশি হবার কথা। কিন্তু কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার আবাসনের দৈন্যদশা দেখে করুণা হবে তাঁর। জানি এ ধরণের হীনমন্যতাকে প্রশ্রয় দেয়া উচিত নয়। কিন্তু কী করবো, ভাবনার ডালপালা যে গজাতে শুরু করেছে। ফিল আর ফিলের অস্থায়ী গার্লফ্রেন্ডকে দেখলে কী ভাববেন আলী সাহেব? বাসার পরিবেশ সম্পর্কে কী ধারণা হবে তাঁর?

আলী সাহেব নিশ্চয় বুঝতে পারবেন এ বাসার পরিবেশ গঠনে আমার কোন ভূমিকা নেই। অস্ট্রেলিয়ার ফিল-জাতীয় সামাজিক বোঝা সম্পর্কে আলী সাহেব নিশ্চয় সচেতন। কিন্তু ভাবনা হচ্ছে তাঁকে দেখে ফিল কেমন ব্যবহার করেন। বাসায় কেউ আসুক এটা মনে হয় ফিলের পছন্দ নয়। নইলে কেউ কি দরজার বাইরে নোটিশ টাঙিয়ে রাখে “নো বডি ইজ এলাউড ইন মাই এপার্টমেন্ট, এক্সেপ্ট গার্লফ্রেন্ডস”?

পাঁচটা বাজতে না বাজতেই হৈ চৈ শুরু হয়ে গেছে ফিলের লাউঞ্জরুমে। শুক্রবার বিকেল থেকেই মদের হুল্লোড় শুরু হয়ে যায় এদের সভ্যতায়। ফিলের শুক্রবারের সন্ধ্যার রুটিন সম্পর্কে এখনো কোন ধারণা নেই আমার। মনে হচ্ছে হুল্লোড়টা মাত্রা ছাড়াবে।

ফিলের বান্ধবী ছাড়াও আরো কয়েকজন মহিলার হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। অদ্ভুত জীবন-যাপন এদের। এটা কি স্বাধীনতা নাকি স্বেচ্ছাচারিতা নাকি অন্যকিছু ঠিক বুঝতে পারছি না। এদের জীবনের কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য আছে বলেও তো মনে হয় না। গতকাল সন্ধ্যায় যখন রান্না করছিলাম- ফিল এসে কিছুক্ষণ বক বক করেছেন। মাতাল হয়ে গেলে মানুষের কথার কোন লাগাম থাকে না। অনেকে বলে থাকেন তখন নাকি মুখ দিয়ে সত্যি কথাই বেরোয়। জানি না কথাটা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য। ফিল বলেছেন এ পর্যন্ত তিনজনকে বিয়ে করেছেন তিনি, ছাড়াছাড়িও হয়ে গেছে। ডেভিড ছাড়াও আরো সন্তান আছে তার। ঠিক কতজন মনে করতে পারলেন না। এমনকি তারা কোথায় আছে তাও জানেন না। জানার দরকার বোধও করেন না মনে হয়।

ফিলের বর্তমান বান্ধবীর নাম ক্যাথি। থাকে সামনের বিল্ডিং এ। ক্যাথিরও নিশ্চয় বিয়ে হয়েছিল অনেক বার, ছেলেমেয়েও আছে নিশ্চয়। আমাদের সমাজ ব্যবস্থার সাথে এদের কত পার্থক্য। আমাদের মা-বাবারা নিজেদের জীবন সাজিয়ে নেন সন্তানদের কেন্দ্র করে। সন্তানরা বড় হয়ে গেলে মা-বাবারা নিজেদের জীবন নিয়ে আলাদা করে কখনোই ভাবেন না। আর এখানে জীবন কত অন্যরকম।

রুম গোছানোর তেমন কোন দরকার হলো না। আমার জিনিসপত্র এত কম যে অগোছালো হবার কোন সুযোগই নেই। বাথরুমের আয়নায় মুখ দেখে নিজেকে কেমন যেন হতাশাগ্রস্তের মত মনে হলো। দু’দিন শেভ না করার ফল। খুব অনাগ্রহের সাথে যে সমস্ত কাজ আমাকে করতে হয় – শেভ করা তাদের একটি। দাড়ি রেখে দিতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু মামামের কড়া হুকুম- দাড়ি রাখা চলবে না, প্রতিদিন শেভ করতে হবে। প্রতিদিন শেভ করলে নাকি আত্মবিশ্বাস বাড়ে। প্রতিদিন শেভ না করলে আত্মবিশ্বাস কতটুকু কমে জানি না, কিন্তু আলসেমির কারণে প্রতিদিন শেভ করা হয় না।

আলী সাহেবের আগমন উপলক্ষে শেভ-টেভ করে বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখি সব চুপচাপ হয়ে গেছে। লাউঞ্জ রুমে কারো কোন সাড়াশব্দ নেই। রুমে ঢোকার আগে লাউঞ্জে উঁকি দিলাম। কোথাও কেউ নেই। আবছা অন্ধকার ঘরে এক জোড়া চোখ জ্বল-জ্বল করছে, ফ্লপির। আমার পায়ের শব্দ শুনে ফ্লপি বললো “মিয়াঁও”।

ফিলরা কেউ না থাকাতে খুব হালকা লাগছে। তারা ফিরে আসার আগেই যদি আলী সাহেব চলে আসেন খুব ভালো হয়। ছ’টার দিকে নিচে নেমে এলাম। সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম আলী সাহেবের গাড়ির জন্য।

সূর্য ডুবে গেছে কত আগে। আজ সকালে সামান্য বৃষ্টি হয়েছিল, তারপর সারাদিন রোদ ছিল। ঠান্ডাও কিছুটা কম মনে হচ্ছে এখন। আসলেই কম নাকি আস্তে আস্তে অভিযোজিত হয়ে যাচ্ছি ঠিক জানি না। বেশ কয়েকটা গাড়ি এসে পার্কিং লটের বিভিন্ন জায়গায় থেমে গেলো। আলী সাহেবের ফোর্ড ফ্যালকন এলো আরো কিছুক্ষণ পর, সাড়ে ছ’টার দিকে।

গাড়ি থেকে তিনি বেরোতেই আমি এগিয়ে গেলাম।
“বেশ বড় পার্কিং এরিয়া দেখছি। অস্ট্রেলিয়ান গভমেন্ট লো-ইনকাম আর্নারদের জন্য কত সুযোগ সুবিধে দিচ্ছে দেখেছো? এগুলো সব গভমেন্ট হাউজিং”
“জ্বি স্যার। আসেন”
“দোতলায় না?”
“জ্বি স্যার”

সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় আলী সাহেব পকেট থেকে রুমাল বের করে নাকে চাপা দিলেন। সিঁড়িতে প্রশ্রাবের গন্ধটা কি আজো আছে? আমি টের পাচ্ছি না। তবে কি গন্ধটাও আমার নাক-সহা হয়ে যাচ্ছে?
“হুমায়রা ভাবী চিঠি লিখেছেন তোমার ভাবীকে। তোমার সম্পর্কে অনেক প্রশংসা করেছেন চিঠিতে”- বাসায় ঢুকতে ঢুকতে বললেন আলী সাহেব।
“চিঠি পেয়ে তোমার ভাবী বললেন আমি যেন নিজের চোখে দেখে যাই তুমি কেমন আছো। ব্যবস্থা ভালো না হলে যেন সাথে করে নিয়ে যাই আমাদের বাসায়। আমাদের অত বড় বাড়ি”
“আমার কোন অসুবিধে হচ্ছে না স্যার। এখানে সব কিছু আছে”
“তাই তো দেখছি। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে ইউনিভার্সিটির এত কাছে। বিট্টুর তো আর-এম-আই-টি’তে আসতে যেতেই দু’ঘন্টা চলে যায়”

আলী সাহেব আমার রুম দেখলেন, লাউঞ্জরুম দেখলেন, রান্নাঘর দেখলেন। দেখে সন্তুষ্ট হলেন। ফিল না থাকাতে আমার কী যে সুবিধা হয়েছে।
“ও-কে দ্যান। আমাকে যেতে হবে। ফ্রাইডে ট্রাফিক যে কী বস্তু গাড়ি না চালালে বুঝবে না”
বের হতে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন আলী সাহেব।
“তোমার টয়লেটটা কোন্‌ দিকে?”

মনে হলো চারশ চল্লিশ ভোল্টের একটা ইলেকট্রিক শক খেলাম। টয়লেটের কথা আমার মনেও ছিল না। এখন আলী সাহেব যদি টয়লেটে ঢোকেন আর টয়লেটের দেয়ালে লাগানো পর্নো পোস্টারগুলো দেখেন- আমাকে আর মুখ দেখাতে হবে না। আমাকে সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করবেন না, কিন্তু মনে মনে যা ভাববেন তা ভালো কিছু নয়। আমি তো আগ বাড়িয়ে বলতে পারবো না যে পোস্টারগুলোতে আমার কোন হাত নেই। হুমায়রা আপার দেয়া আমার ভালোত্বের সার্টিফিকেট এক মুহূর্তে ছ্যাড়াব্যাড়া হয়ে যাবে। আলী সাহেবকে কিছুতেই টয়লেট দেখানো যাবে না। কিন্তু কোন্‌ অজুহাতে?

প্রয়োজনই আবিষ্কারের প্রসূতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে কত কম সময়ের মধ্যে কত বেশি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হয়েছে। আমারও এখন হঠাৎ যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সম্মান বাঁচানোর যুদ্ধ। এ যুদ্ধে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে- বিশ্বাসযোগ্য ভাবে মিথ্যা বলা। তাই করতে হলো। বললাম “ওদিকে। আমি দেখে আসছি ফ্রি আছে কি না”।

টয়লেটের সামনে এসে দরজায় টোকা দিয়েই বেশ জোরে বললাম, “ওহ্‌, সরি”। এমন ভাব করলাম যেন ভেতরে কেউ আছে। আলী সাহেবকে এসে বললাম- “একটু অপেক্ষা করতে হবে, টয়লেট এনগেজ্‌ড”।

শুক্রবারের সন্ধ্যা। আলী সাহেবকে যেতে হবে অনেক দূর। অপেক্ষা করার সময় তাঁর না থাকারই কথা। আর অপেক্ষা করতে চাইলেও করতে পারেন। যতই অপেক্ষা করুন টয়লেট এনগেজড্‌ই থাকবে। টয়লেট থেকে তো কেউ বেরোবে না।

আলী সাহেব অপেক্ষা করলেন না। বেরিয়ে গেলেন। আমিও দরজায় তালা লাগিয়ে তাঁর পিছু নিলাম।
“এবার একটা পার্ট-টাইম কাজ জোগাড় করতে পারো কি না দেখো। যে কোন ধরনের কাজ। এদেশে কোন কাজই অসম্মানের নয়। বিট্টুতো রেস্টুরেন্টের কিচেনে কাজ করে। আমি তাকে বলেছি তোমার জন্য কাজ দেখতে। তুমিও তাকে ফোন করে বলো”
“জ্বি স্যার, বলবো”
“সুপার মার্কেটগুলোতে দেখতে পারো। কালতো স্যাটারডে। কালকের পেপারে অনেক এড থাকবে পার্ট-টাইম জবের। ক্লিনিং টাইপের জবগুলোতে ফোন করে দেখো। একটা না একটা হয়ে যাবে”
“জ্বি স্যার”
“ও-কে দ্যান। টেক কেয়ার”

আলী সাহেবের গাড়ি পার্কিং লট থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। তারপর চলে এলাম রুমে।

মানুষ মানুষের জন্য এরকম নিঃস্বার্থভাবে কাজ করছে দেখলে একটা প্রশ্নই মনে আসে বার বার- আমি কি কখনো কারো জন্য কিছু করতে পারবো? এরকম নিঃস্বার্থভাবে? আমি এদেশে ভালো থাকি কি মন্দ থাকি তাতে হুমায়রা আপা বা আলী সাহেবদের কী আসে যায়? অথচ আমার জন্য তাঁরা কত ভাবছেন। ভালোবাসার এত ঋণ আমি কীভাবে শোধ করবো?

ক্রমশঃ_____________